১৫ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১১

অন্যের নামে ঋণ নিয়েছেন ব্যাংকের পরিচালক

সাউথ বাংলা ব্যাংকে ২৫৮ কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আমির হোসেনের নামে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে থাকা শেয়ারের প্রকৃত মালিক রতনপুর গ্রুপের কর্ণধার মাকসুদুর রহমান। সেই শেয়ার বন্ধক রেখে আমির হোসেনকে ২৫ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। আমির হোসেনের নামে সৃষ্ট এ ঋণকে মাকসুদুর রহমানের বেনামি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাকসুদুর রহমান সাউথ বাংলা ব্যাংকের পরিচালক ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান। তার বেনামি ঋণসহ ব্যাংকটির গুলশান ও পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জ শাখার ২৫৮ কোটি টাকার ঋণে গুরুতর অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাযথ সঞ্চিতি সংরক্ষণ না করে ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক তথ্য আড়াল করেছে সাউথ বাংলা ব্যাংক। এ ছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন গ্রাহককে ঋণ, মঞ্জুরিপত্রের শর্ত শিথিল, বিচার-বিশ্নেষণ না করে অন্য ব্যাংকের ঋণ অধিগ্রহণের নামে বাড়তি সুবিধা এবং সীমাতিরিক্ত ঋণ থাকা অবস্থায় নতুন ঋণ দেওয়া হয়েছে। শাখা ব্যবস্থাপনা, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটি, পরিচালনা পর্ষদ ও পর্ষদের নির্বাহী কমিটির পারস্পরিক যোগসাজশে এসব অনিয়ম হয়েছে।

জানতে চাইলে সাউথ বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন সমকালকে বলেন, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ারের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। গুলশান এবং ইমামগঞ্জ শাখার অন্যান্য ঋণ অনিয়মের বিষয়ে বলেন, যথারীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উত্তর দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা পর্যালোচনা করে ব্যাংককে জানানোর পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন তথ্যবহুল ছিল না। এখন তথ্যপ্রমাণসহ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে মাঝেমধ্যেই নানা ভুলত্রুটি ধরা পড়ে। তবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা হয় খুব কম। এসব ব্যাংক ভালোভাবে চালাতে হলে তদারকি আরও জোরদার করতে হবে। অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকটিকে জরিমানা বা পরিচালককে বের করে দেওয়া যেতে পারে।

পরিচালকের বেনামি ঋণ :বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আমির হোসেনকে আটলান্টিক রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান দেখিয়ে সাউথ বাংলা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ২০ কোটি টাকার ঋণ আবেদন করা হয়। অথচ দীর্ঘদিন তিনি দেশে আসেননি। এমনকি আমির হোসেনকে পরিচয়দানকারী সাখাওয়াত হোসেনও তাকে চেনেন না। এই আমির হোসেনের আবেদনের মাত্র তিন দিনের মাথায় গত বছরের ২১ জুন পরিচালনা পর্ষদ ২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে। এনআরবিসি ব্যাংকে আমির হোসেনের নামে থাকা ২০ কোটি টাকার শেয়ার লিয়েন রাখার শর্তে ঋণটি দেওয়া হয়। তবে পরের মাসে শেয়ার লিয়েনের শর্ত থেকে অব্যাহতি এবং ঋণসীমা বাড়িয়ে ২৫ কোটি টাকা করা হয়। ২৫ কোটি টাকা ঋণের মাত্র ৭ লাখ টাকা গেছে আটলান্টিকের হিসাবে। বাকি ২৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা রতনপুর গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা নগদে তুলে রেক্স মটরসের হিসাবে জমা করেন। রেক্স মটরস রতনপুর গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। বর্তমান প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা 'কল ব্যাক' বা খেলাপি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক পরিদর্শনে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে মাকসুদুর রহমানের বেনামি শেয়ারের তথ্য উঠে আসে। তখনও এই আমির হোসেনকে ব্যবহার করেন মাকসুদুর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের প্রতিবেদনে বলা হয়, এনআরবিসিতে আমির হোসেনের ছদ্মাবরণে কেনা ২০ কোটি টাকা শেয়ারের প্রকৃত মালিক মাকসুদুর রহমান। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ওবি শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করে পরিদর্শক দল। আরএসআরএম স্টিলের স্বত্বাধিকারী মাকসুদুর রহমান এখন নানা কারণে ব্যাংক খাতে আলোচিত। বছর দুয়েক আগে রতনপুর গ্রুপের ৬টি ব্যাংকে যোগাযোগ করা হলে ৯২৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হলেও ওই ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন খেলাপি।

এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মাকসুদুর রহমান সমকালকে বলেন, আমির হোসেনের নামে সৃষ্ট ঋণ থেকে রেক্স মটরসে কোনো টাকা যায়নি। আমির হোসেনের লোক যে এসব টাকা তুলেছে সে বিষয়ে এরই মধ্যে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমির হোসেন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। তার শেয়ারের বিপরীতে সাউথ-বাংলা ব্যাংকের পর্ষদ ঋণ অনুমোদন করেছে। আমির হোসেন বা আটলান্টিক রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। আমির হোসেন দীর্ঘ দিন দেশে না এলেও ঋণ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাকসুদুর রহমান বলেন, এটা ঠিক না। তিনি শাখায় গিয়ে ডকুমেন্টে সাইন করার পর ঋণ পেয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসা আপত্তির বিষয়ে ইতিমধ্যে জবাব দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন মো. গোলাম ফারুক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসা অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার সময় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন মো. রফিকুল ইসলাম। জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, জ্ঞানত তার সময়ে কোনো অনিয়ম হয়নি। এখন তিনি ব্যাংকে নেই। যেটুকু শুনেছেন কিছু বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ইতিমধ্যে সে সব বিষয়ে জবাব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া একজন গ্রাহক তো আর আজীবন এক ব্যাংকে থাকেন না। ফলে অন্য ব্যাংকের ঋণ অধিগ্রহণ করা কোনো অন্যায় নয়। এখন আর ব্যাংকে না থাকায় এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি জানেন না বলে জানান।

৮৫ কোটি টাকা খেলাপি করার নির্দেশ :মাকসুদুর রহমানের বেনামি ঋণের ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকাসহ ব্যাংকটির গুলশান ও ইমামগঞ্জ শাখার চার গ্রাহকের ৮৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ইমামগঞ্জ শাখার গ্রাহক আড়িয়ান ট্রেডিংকে কর্ণফুলী পেপার মিলের কার্যাদেশের বিপরীতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ১২০ দিনের জন্য ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি সুবিধা দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ে এ অর্থ আদায় না হলেও খেলাপি না করে ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠানটিকে ২৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ঋণখেলাপিতে পরিণত হলেও তা নিয়মিত দেখিয়ে প্রকৃত আর্থিক চিত্র আড়াল করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আড়িয়ান ট্রেডিংয়ের নামে ২০১৪ সালের জুলাইতে ৩০ কোটি টাকার ঋণের আবেদন আসে। সেখানে অন্য ব্যাংকের দায় অধিগ্রহণের বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকলেও পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটি ট্রাস্ট ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায় অধিগ্রহণসহ ২ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ, ৬ কোটি টাকার এলটিআর, চলতি মূলধন হিসাবে ৮ কোটি টাকার এলসি ও ৫ কোটি টাকার সিসি অনুমোদন করে। অথচ ট্রাস্ট ব্যাংকের ঋণ অধিগ্রহণ বাবদ ৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা পরিশোধ করেন গ্রাহক। যার সাড়ে ৪ কোটি টাকা দেওয়া হয় সিসি ঋণ থেকে, যা নীতিমালার লঙ্ঘন।

এ শাখার আরেক গ্রাহক মাদালি শাহ অ্যাসোসিয়েটসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ট্রেড সোর্সকে ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ অধিগ্রহণ বাবদ ৯১ লাখ ৮৮ হাজার, চলতি মূলধন ১ কোটি ২০ লাখ এবং ৫০ লাখ টাকার মেয়াদি ঋণ অনুমোদন করা হয়। আর মাদালি শাহকে দেওয়া হয় ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। উভয় প্রতিষ্ঠানের ঋণের অর্থের অধিকাংশই নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্র্যাক ব্যাংকের দায় পরিশোধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা খেলাপি করতে বলেছে পরিদর্শক দল।

সাউথ-ইস্ট ব্যাংকের দায় অধিগ্রহণসহ ৭ কোটি টাকার ঋণের জন্য ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে গুলশান শাখায় আবেদন করে হাছান অ্যান্ড ব্রাদার্স। এক সপ্তাহের মাথায় অধিগ্রহণসহ সাড়ে ৪ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি এবং আড়াই কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি সুবিধা দেওয়া হয়। পরে কয়েক দফায় ঋণসীমা বাড়িয়ে ২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। তবে তাকে দেওয়া হয় ৩৩ কোটি টাকা। এ ঋণের টাকায় নিয়ম বহির্ভূতভাবে ন্যাশনাল ব্যাংকের দায় পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। হাছান ব্রাদার্সের কাছে ব্যাংকের পাওনা ২৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা খেলাপি করতে বলা হয়েছে। এ শাখার আরেক গ্রাহক ব্লুজম নামের একটি বন্ধ হোটেল চালুর জন্য ২০১৪ সালে আবেদন আসে। সাজসজ্জা বাবদ পাঁচ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ অনুমোদন করে পর্ষদ। এর মধ্যে ৪ কোটি ৭৫ লাখ নগদে উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটি। পরে বাকি ২৫ লাখ টাকা তুলে একই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়। এরপর আবার প্রতিষ্ঠানটিকে ৭৫ লাখ টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিয়ে আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বর্তমানে ব্যাংকের পাওনা ৪ কোটি ৯ লাখ টাকা খেলাপি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আরও যত অনিয়ম :লংকা-বাংলা ফাইন্যান্সের নামে ২০১৪ সালের অক্টোবরে ৪০ কোটি টাকার ঋণ দেয় ব্যাংক। পরের বছর প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ কোটি টাকার আরও দু'টি ঋণ দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১২ মার্চ আগের ১০ কোটি টাকার একটি ঋণ ২০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এভাবে গ্রাহককে ১০০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। যার পুরোটায় বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে ওয়ান ব্যাংকে স্থানান্তর করে লংকা-বাংলা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংক পাবে ৭৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর পরিদর্শনকালীন অন্যান্য ব্যাংকে লংকা-বাংলার ঋণ ছিল ৫৯৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের নামে হিসাব খোলার আগেই ২০১৫ সালের জুলাইতে পাঁচ বছর মেয়াদি ১৫ কোটি টাকার ঋণ দেয় ব্যাংক। পরে কয়েক দফায় আরও ২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। বিভিন্ন কাজের নামে দেওয়া ঋণের ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। পরিদর্শনকালীন অন্যান্য ব্যাংকে এফএএস ফাইন্যান্সের ঋণ ছিল ৩৪০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাউথ বাংলা ব্যাংকের ঋণের টাকায় লংকা-বাংলা ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অন্য ব্যাংকে বিদ্যমান দায় পরিশোধ করেছে। প্রকৃত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবে ঋণের ব্যবহারকে আড়াল করতে উভয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে অর্থ স্থানান্তর করেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার লঙ্ঘন।

http://www.samakal.com/economics/article/1803931