১৫ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১০

খেয়া পাড়ে নেই যে খেয়া... হেঁটেই পার হওয়া যায় নদী

বঙ্গবন্ধু সেতুর উভয় পাড়ে জেগে উঠেছে বিশাল চর

করালগ্রাসী রাক্ষুসী খরস্রোত ধারার প্রমত্ত যমুনা নদী যেন আর নদী নেই। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় ও পূর্বপাড় (টাঙ্গাইল অংশের) বিশাল চর জেগে উঠেছে। সেতুর দক্ষিণে প্রায় ১০ হাজার বিঘা জমি মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, পূর্ব পশ্চিম আর উত্তর দক্ষিণের সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা নদীর সাথে সম্পৃক্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, ও সিরাজগঞ্জ পাবনা অংশে নদী ও শাখা নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ডানে বামে যতদুর চোখ যায় শুধু ধু ধু বালুচর। যমুনার অভ্যন্তরীণ রুটে খেয়া পাড়ে এখন আর নৌকার প্রয়োজন পড়ে না। এক সময়ের প্রমুত্ত উত্তাল তরঙ্গের যৌবন প্রাপ্ত রাক্ষুসী যমুনা এখন তার নাব্য হারানোর জন্য এ নদী এখন হেটেই পাড় হওয়া যায়। সিরাজগঞ্জ বাঘাবাড়ী একমাত্র নৌবন্দরও হুমকীর সম্মুখীন। এ অবস্থায় উত্তরাঞ্চলের কৃষি পণ্য জ্বালানী তেল সরবরাহে অচল অবস্থার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী চারাবাড়ী, পোড়াবাড়ী নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। সিরাজগঞ্জের পাঁচটি শাখা নদী ও টাঙ্গাইলের ১২টি অভ্যন্তরীণ নদী এখন নালায় পরিণত হয়েছে। চোখ ধাধানো বর্ণিল সবুজ ফসলের সরব উপস্থিতির কারণে সিরাজগঞ্জসহ পূর্ব পাড় টাঙ্গাইল উত্তরের জামালপুর ও দক্ষিণে পাবনা জেলায় অনেক কৃষক তাদের গরুচরাতে যমুনায় বৃহত্তর চরে উপস্থিত হচ্ছে। জনবসতীহীন অনেক চরে এখন বসেছে ফসল আবাদের প্রাণের মেলা। সব কিছু মিলিয়ে শুস্ক মৌসুমে এহেন সমস্যা আরও ঘনিভূত হবে বলে নদী বিশেষজ্ঞরা তাদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর পশ্চিম দিকের দক্ষিণ পাশে ২নং পিলার থেকে ১৫নং পিলার পর্যন্ত এবং পশ্চিম দিকে উত্তর অংশে ৪ থেকে ১৭নং পিলার পর্যন্ত বিশাল চর জেগে উঠেছে। এছাড়া সেতুর উত্তর দিকে ৪০-৪১ পিলার পর্যন্ত উভয় পাশে রয়েছে মারাত্মকভাবে জেগে উঠা ডুবোচরও। পূর্ব পাশের (টাঙ্গাইল) ৪৫ পিলার থেকে শেষ পিলার পর্যন্ত গাইড বাঁধ অংশে একটুও পানি নেই। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে জেগে উঠা ছোট-বড় অসংখ্য চর পুরো শুষ্ক মৌসুমে অবস্থা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করার সমূহ আশঙ্কা বিরাজ করছে। অপরদিকে, উত্তরাঞ্চলের প্রধান নৌ-বন্দর বাঘাবাড়ীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী যমুনা নৌপথের ১২টি পয়েন্টে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। ক্রমেই নাব্য সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এখানে যমুনা নদীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর, দৃশ্যমান চরের চেয়ে নৌপথে ডুবোচর আরো ভীতিকর। পণ্যবাহী, তেলবাহী কার্গো মাঝে মধ্যেই যমুনার ডুবোচরে আটকে পড়ছে। আটকা পড়া কার্গো জাহাজ নাব্য সংকট কাটিয়ে বা অন্য কোন উপায়ে ছাড়া পেলেও সারেং-এর ভয়ভীতি অন্যত্র । নদীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা চর (ডুবোচর) একজন সারেং এর কাছে চোরাবালির মতই ভীতিকর। হঠাৎ সজোরে জাহাজ কার্গোর তলদেশে আঘাত লেগে ফেটে যেতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যেতে পারে জাহাজ। নাব্য সংকট কাটিয়ে এবং ডুবোচর অপসারণ করে নৌপথের স্বাভাবিক ড্রাফটিং এর ফিরিয়ে আনা না গেলে যে কোন মুহূর্তে বাঘাবাড়ি নৌবন্দরগামী জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পন্যবাহী কার্গো চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর এটি হলে উত্তরাঞ্চলের জ্বালানি তেলসহ কৃষি পণ্য, সার সরবরাহ মারাত্মক সঙ্কট দেখা দেবে। পুরো শুস্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের তেল-ডিজেলবাহী ও সার বোঝাই অনেক কার্গো জাহাজ পাবনা বাঘাবাড়ি এবং রাজবাড়ী জেলার দৌলদিয়া এলাকার নদীর নাব্যতার অভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ মাঝ নদীতের নোঙর করে নৌকায় কিছু মালামাল আনলোড করে কার্গো জাহাজগুলো পানির মিটার মেপে আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্য যাত্রা করে নৌপথ সচল করে থাকে। মাত্র ১৫ বছর আগেও উত্তরাঞ্চলের এসব নদীই ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান রুট। এরই মধ্যে কিছু কিছু নদীর অস্থিত্ব ও খোঁজে পাওয়া দুরুহ। হাজার হাজার নৌ- শ্রমিক বেকার হয়ে তারা এখন অন্য পেশার সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে। প্রায় হাজারও পরিবার সারা বছর নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। তারা তাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে কেউ চালায় রিক্সা বা কেউ হয়েছে দিনমজুর। অতীতে এসব নদীর পানি হাজার হাজার হেক্টর জমির ইরি-বোরো আমনসহ বিভিন্ন ফসল চাষে সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে চাষাবাদ হতো। এখন এসব নদীর তটে আর সে সব আবাদ হয় না বললেই চলে। নদীর বুকে পানি ও বালি জমে ভরাট হওয়ার কারণে এসব নদীগুলো পানি ধারন ক্ষমতা হারাবে। এর ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিস্কাশন না হলে কৃত্রিম বন্যা সৃষ্টি হবে। অপর দিকে দৌলতদিয়া নগরবাড়ি-বাঘাবাড়ী ও অন্যান্য মালামাল পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর। এ পথে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সারও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ি বন্দর থেকে উত্তরজনপদের ১৬ জেলার চাহিদার প্রায় ৯০% জ্বালানি তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে বাঘাবাড়ি বন্দরের মাধ্যমে চাল, গমসহ বিভিন্ন পন্য সামগ্রী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু শুস্ক মৌসুম শুরু হওয়ায় প্রারাম্ভেই নাব্য সংকটে পড়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ রুটটি। যমুনা নদীর দক্ষিণের পাবনার বেড়াকোলা থেকে উত্তরের রংপুরের কাউলিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩৫ মাইল নদী বক্ষে ছোট বড় অগনিত চর ও ডুবো চর জেগে উঠায় নৌ-চলাচল মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হবার আশংকা দেখা দিয়েছে। নেইলশার চর, গাবসাড়া, শিশুয়া, চৌদ্দবাড়ী, রাধানগর এলাকার চরের আয়তন ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। বালুর স্তর পুরু হওয়ায় নৌযান চলাচল হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন এই নদী বক্ষে নতুন নতুন চর জেগে উঠায় নৌপথ প্রর্দশন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জাহাজ, কার্গো, ফেরী এমন কি দেশীয় নৌকা চলাচলের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে ৫ ফুটের অধিক ড্রাফটের নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সত্তে¡ও তা উপেক্ষা করে চলাচল করতে গিয়ে বিস্তৃত এ যমুনা নদী পথের কোন না কোন চরে সেগুলো আটকে পড়ছে।

প্রধান নদী রুট ছাড়াও সিরাজগঞ্জ থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত ৩০ মাইল এলাকায় প্রায় ২০-২৫টি স্থানীয় রুট রয়েছে। গ্রাম থেকে গ্রাম কিংবা চর থেকে চরের মানুষ এসব পথে মাঝারী আকারের দেশী নৌকাযোগে পাড়াপাড় হয়। কিন্তু চলতি বছর এসব রুটে দেশী নৌকা ও চলাচল করতে পারছে না। এমনও দেখা যাচ্ছে যে, দুর পথগামী নৌকা গুলো মাঝ পথে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে চরের বালু ও অতি সামান্য পানির উপর দিয়ে নৌকা হাতে ঠেলে পার করছে, তারপর আবার তুলে নিচ্ছে যাত্রী। অপর দিকে দীর্ঘ যমুনা পথে চর পড়ায় হেটেই পার হচ্ছে মানুষ, খেয়া পাড়ের আর প্রয়োজন পড়ছে না। এদিকে সিরাজগঞ্জের কাছে পূর্ব সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর পানি হ্রাস পাওয়ায় নদী বক্ষে যত্রতত্র জেগে উঠছে চর-ডুবোচর, ফলে নদীর ১০টি রুটে নৌ চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। মেঘাই ঘাট থেকে প্রতিদিন নাটুয়ারপাড়া, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, খাসরাজবাড়ি, চর গিরিশ, মনসুর নগর, তারাকান্দি, সিরাজগঞ্জ, সড়াবাড়ি, রূপসার চর, কাওয়াখোলা চর, ম্যাচড়া চর ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল ব্যহত হচ্ছে। নদীর নাব্য কমে চর জেগে উঠায়, অনেক দুর দিয়ে ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। এতে তেল খরচ ও সময় দুটিতেই বেশী খরচ হচ্ছে। ফলে, যাত্রী খরচ ও মালামাল পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এসব রুটে অন্য কোন যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রীরা বিপাকে পড়ছে। নদীর পানি কমে নৌ ঘাট দুরে সরে যাওয়ায় তপ্ত বালুচর ভেঙ্গে যাত্রীদের যাতায়াত করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে মালামাল পরিবহনসহ শিশু-নারী যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। নৌ-রুট বন্ধ থাকায় অনেক স্থানের মাঝিরা যেমন বেকার হয়ে পড়েছে তেমনি মৎসজীবিরা দুচোখে সরিষার ফুল দেখছে। যমুনা নদীর পানি হ্রাস পেলে ৩কি.মি. পথ বেড়ে ১২ কি.মিটারে পৌছে। টাঙ্গাইল জেলার প্রবাহমান ধলেশ্বরী, লৌহজং, বংশাই, ঝিনাই শাখা ও অভ্যন্তরীণ নদী অবস্থান একই রকম। খুব বেশী দিনের কথা নয় জেলার ফুলজোড়, করোতোয়া, গুমানী, কাটাখালী অভ্যন্তরীণ নদী ও চলনবিল অঞ্চলে পথে ঢেউয়ের তালে চলতো পাল তোলা নৌকা। ভাটিয়ালি আর পল্লীগীতি গানের সুরে মাঝিরা নৌকা নিয়ে ছুটে চলেছে বিভিন্ন জেলা, থানা, উপজেলা এবং নদী কেন্দ্রীক ব্যবস্যা কেন্দ্রগুলোতে। শহরের প্রাণ কেন্দ্র বাহিরগোলা ছিল ‘প্রাচ্যের ম্যানচেষ্টার’ নামে পরিচিত। এ শাখা নদীগুলো গিরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠে বড় বড় হাট বাজার সমূহ ব্যবসার জন্য পাট, আলু, ধান, সরিষা, বেগুন, কালাই, গম, ভুট্টা সহ নানাবিধ কৃষিপণ্য নিয়ে সওদাগররা নৌকায় পাল তুলে মাঝি মাল্লা নিয়ে ছুটে চলতেন। শুধু কৃষি পণ্যই নয়, হাট বাজার গুলোতে বিক্রির জন্য তারা নিয়ে যেতেন গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষসহ অন্যান্য পণ্য। এই সময় যমুনাসহ শাখা নদীগুলোর ছিল পূর্ণ যৌবন। এ নদীকে অবলম্বন করে অসংখ্য মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবন-জীবিকার রাস্তা খোঁজে পেয়েছে। শুধু হাট বাজারই নয়, এ নদী কেন্দ্রীক গড়ে উঠে ছিল অনেক জনপদ। নদীর অথৈ পানি দিয়ে কৃষক তাদের জমি উর্বর করে ফসল ফলাতেন। প্রকৃতির অফুরন্ত পানিতে নানা ফসলে ভরে যেত এ জমি। সেও এক নয়াভিরাম দৃশ্য মানষ পটে ভেসে উঠে। জীবিকার সন্ধানে নদী সংলগ্ন ও আশ-পাশ এলাকায় অসংখ্য জেলে পরিবার বসত ভিটা গড়ে উঠেছিল। মাছ মেরে তাদের সংসার চলত। সেই সোনালী দিন যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? এ প্রশ্নের জবাব দিবে কে?

 

https://www.dailyinqilab.com/article/121522