১৪ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৭:৪৮

যান চলাচলের অযোগ্য এক বছরেই!

ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন সংস্কারে ৭৫০ কোটি টাকার প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে

তিন হাজার ৮১৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ২০১৬ সালের ২ জুলাই। নির্মাতাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই সড়কের ভারবাহী ক্ষমতার কোনো ক্ষতি হবে না, কোনো সংস্কারও করতে হবে না। কিন্তু মাত্র এক বছর পার না হতেই সড়কটি যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সিটি গেট থেকে চট্টগ্রাম জোনের ৬৬ দশমিক ৩৮ কিলোমিটারসহ ১৯০ কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের জন্য নতুন করে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। এ প্রকল্পে মেরামত ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। প্রকল্প-সংশ্নিষ্টরা দাবি করছেন, স্কেলে দুর্নীতি, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ভারবাহী যান চলাচল এবং নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর কারণেই হাজার কোটি টাকার সড়কের এই হাল।

সওজ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও সদ্যসমাপ্ত চার লেন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফতাব হোসেন খান সমকালকে বলেন, 'সড়ক দিয়ে সংখ্যায় বেশি এবং ওভারলোডেড যানবাহন চলাচল করায় সঙ্গত কারণেই প্রতিদিন মেগা এ প্রকল্পের ক্ষতি হচ্ছে। মেরামতও চলছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রায় ছয় মাস আগেই এ সড়কে পাঁচ বছর ধরে সংস্কারের জন্য প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যখন এটি নির্মাণ করছিল তখন প্যানেল অব এক্সপার্টদের পক্ষ থেকেও অত্যধিক ভারবাহী যান চলাচলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়কটি নিয়মিত পরিচর্যা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।' প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লা অঞ্চলের ১২৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম জোনে ৬৬ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার মেরামত করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া স্থান বিশেষে মজবুতকরণ, সিগন্যাল ও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাবও করা হয়েছে পাঠানো ডিপিপিতে। ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য সংস্কারের এ প্রস্তাব পাঠানো হয়।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন পরিদর্শনের সময় মিরসরাই এলাকার প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কের পেভমেন্ট নষ্ট দেখা গেছে। প্রকল্প পরিচালক সম্প্রতি জানিয়েছেন, পরে এ অংশটি সংস্কার করা হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, এ সড়কের হার্ড সোল্ডারের পাশে মাটির অংশে পানি জমে থাকে। একই অবস্থা ফেনী রেললাইন এলাকায়ও। নিয়মিত এ মহাসড়ক ব্যবহার করেন এমন একজন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আকতার উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, স্কেলে দুর্নীতি ছাড়াও যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় সীতাকুণ্ডের বারৈয়ারহাটসহ একাধিক পয়েন্টে ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া দরকার।

চার লেন সড়কটির নকশা করার সময় সম্মিলিত আদর্শ স্কেল বা ভারবহন ক্ষমতা ধরা হয় সাড়ে নয় কোটি, যা ২০২৩ সালে অতিক্রম করার কথা। কিন্তু দেখা গেছে, ২০১৭ সালেই আদর্শ স্কেলের এর ভারবহন ক্ষমতা অতিক্রম করেছে সড়কটি। ২০১৭ সালে চার লেনে ট্রাফিক ও এক্সেল লোড সমীক্ষা থেকে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। এতে দৈনিক প্রায় ৬০ হাজার যান (যেগুলোর মধ্যে ১০-১২ হাজার ওভারলোডেড ট্রাক-কার্ভাডভ্যানও রয়েছে) চলাচল করায় মহাসড়কটিতে মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। সওজের গাইডলাইন অনুসরণ না করায় মহাসড়কটির আয়ুস্কালও দ্রত কমে আসছে। এতে আগামী বছরগুলোতে সড়কটির উপরিভাগ স্বাভাবিক রাখা দুস্কর হয়ে উঠবে। বর্ষাকালে সড়কের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক বিশেষজ্ঞরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন সংশ্নিষ্ট প্রকৌশলী সমকালকে বলেন, মহাসড়ক নির্মাণে এক সময় বিটুমিন ও পাথর নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এক ধরনের পাথরের বিটুমিন ধারণ ক্ষমতা একেবারে কম হওয়ায় অন্য ধরনের পাথর আনা হয়েছিল। বুয়েটের প্রকৌশলীদের মাধ্যমে এগুলো পরীক্ষাও করা হয়। বৃষ্টিতে সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার এটিও অন্যতম কারণ হতে পারে।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সড়ক বিশেষজ্ঞ স্বপন কুমার পালিত সমকালকে বলেন, সড়কের ভারবাহী ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে তিন বিষয়ে কোনো অবস্থাতেই আপস করা যাবে না। এগুলো হলো- ডিজাইন, যথাযথ মালামাল ও নির্মাণের সময় যথাযথ তত্ত্বাবধান। এ ছাড়া সড়ক করার সময় টেস্ট ও যথাযথ সারফেস ড্রেনেজ সিস্টেম রাখতে হবে। তিনি মনে করেন, চার লেন সড়ক নির্মাণে নিশ্চয়ই রাবারাইজড বা সিআরএমবি (ক্রাম রাবার মোডিফায়েড বিটুমিন) ও পিএমবি (পলিমার মোডিফায়েড বিটুমিন) ব্যবহার করা হয়নি। তা করা হলে সড়কটির উপরিভাগ নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত শক্ত রাখা সম্ভব হতো। কাজ শেষ করতে না করতেই হাজার কোটি টাকার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহন করতে হতো না।

http://www.samakal.com/whole-country/article/1803863