গড়াইয়ের বুকজুড়ে এখন ধু ধু বালুচর। শুকনো মৌসুম শুরু না হতেই কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া থেকে খোকসা পর্যন্ত গড়াই পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াইয়ের বুকে মাইলের পর মাইল বালুচরের সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সুন্দরবনকে রক্ষা ও দক্ষিণের কয়েকটি জেলায় নোনা পানির আগ্রাসন ঠেকাতে এ নদী খননে দুই দফা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। দু’দফায় হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হলেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অপরিকল্পিত খনন ও অনিয়ম-দুর্নীতিতে প্রকল্পটি বারবার ব্যর্থ হলেও আবার প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এ বছরে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেকে পাস হতে পারে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর এবং মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গড়াই মাগুরা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনা হয়ে সুন্দরবনে গিয়ে মিশেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নোনা পানির আগ্রাসন রুখতে গড়াইয়ের মিঠা পানির বড় ভূমিকা রয়েছে। শুক্রবার গড়াইয়ের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, শুকনো মৌসুম শুরু না হতেই নদীর বুকে মাইলের পর মাইল বালুর চর পড়েছে। মাঝে-মধ্যে কিছু গর্তে দেখা গেছে সামান্য পানি। এই পানি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারছেন নদীপারের মানুষ। ঘোড়াঘাট এলাকায় দেখা গেছে, সেখানে মানুষ পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। নদীর বুক চিরে গড়ে ওঠা কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে লোকজন আসা-যাওয়া করছে। তালবাড়িয়া থেকে খোকসার জানিপুর পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এতে নদী তীরবর্তী এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় উপকূলভাগে মারাত্মক লবণাক্ততা বাড়ছে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে গড়াইয়ে পানি প্রবাহ ধরে রাখতে ১৯৯৭ সালে প্রথম প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ৪২০ কোটি টাকার প্রথম প্রকল্পের বেশির ভাগ অর্থই লুটপাট হওয়ায় উদ্দেশ্য ভেস্তে যায়। এরপর ২০০৯ সালে ৯৪২ কোটি টাকার দ্বিতীয় প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। সাত বছর খনন করে ২০১৬ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। তবে, প্রকল্প শেষ হওয়ার দেড় বছর যেতে না যেতে গড়াইয়ে ফের মরুকরণের প্রভাব বাড়তে থাকে। চলতি বছর শুষ্ক মৌসুমে নদী একেবারে মরাখালে পরিণত হয়েছে। এ জন্য অপরিকল্পিত খনন এবং অনিয়ম-দুর্নীতিকে দায়ী করেছে নদী গবেষক ও সচেতন মহল। অভিযোগ, অপরিকল্পিত খনন এবং অনিয়ম-দুর্নীতিতে হাজার কোটি টাকার গড়াই খনন প্রকল্প ভেস্তে গেছে। দু’পাড়ে অরক্ষিতভাবে লাখ লাখ ঘনমিটার বালু ও কাদামাটি ফেলে রাখা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এসব আবার নদীতে গিয়ে মিশবে। ৮ ফুট উঁচু বালুচর সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও কোনো কাজ হয়নি। হরিপুর অংশে আলাদাভাবে নদীর তীর সংরক্ষণে ১২ কোটি টাকার টেন্ডার হলেও কোনো কাজ হয়নি। অথচ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২০০ মিটার একটি ফ্লো-ডিভাইডার, ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৮৭ মিটার গঙ্গা-গড়াই গাইড বাঁধ নির্মাণের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী হাসান আলী জানান, গড়াইয়ের হরিপুর অংশে নদীতীর সংরক্ষণে ২০১৪ সালে চার গ্রুপে ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকার কাজ করা হয়। কার্যাদেশে সবকিছু স্পষ্ট থাকলেও কোনো শর্তই পূরণ করা হয়নি।
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি বিভাগের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে পাউবোর এক কর্মকর্তা জানান, দুটি ড্রেজার ২৩৪ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে। এছাড়া ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পেছনে ১৫৮ কোটি, অফটেক ফ্লো-ডিভাইডার নির্মাণে ১৫০ কোটি ও গাইড বাঁধের পেছনে ১২০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান বলেন, খননের পর গড়াইয়ের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি। তিনি আরও বলেন, গড়াই বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বৃহৎ পরিকল্পনা নেয়া হলে সুফল মিলবে। পরিবেশ ও নদী গবেষক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, সঠিক কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই বারবার গড়াই খনন প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। গড়াই বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। গড়াই না বাঁচলে এ অঞ্চল থেকে অনেক মাছ ও জলজ প্রাণী হারিয়ে যাবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভৌগোলিক কারণে গড়াই নদীতে প্রচুর পরিমাণে পলি ও বালু জমে। এছাড়া ভাঙনের কারণেও নদীর প্রশস্ততা দিন দিন বাড়ছে। পানি প্রবাহ সচল রাখতে ২৫ ফুট চওড়া ক্যানেল আকারে গড়াই খনন করা হয়।