১৩ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:০০

আকিয়াবের দক্ষিণাঞ্চল নতুন করে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে

রাখাইনে আবার রোহিঙ্গা বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ; রোহিঙ্গাদের ঐতিহ্য মুছে ফেলা হচ্ছে

দুই দেশের স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গারা যাতে তাদের নিজ বাড়িঘরে যেতে না পারেন সে জন্য রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অবশিষ্ট বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করছে স্থানীয় রাখাইনরা। এ ছাড়া রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঐতিহ্যসংবলিত নিদর্শন, স্মৃতিচিহ্ন, ফলক মুছে ফেলছে। এরই ধারাবাহিকতায় মসজিদ ও মাদরাসাগুলোও ধ্বংস করে দিচ্ছে একের পর এক। সেখানে নতুন করে মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ তো করতেই দিচ্ছে না, উপরন্তু সংস্কারকাজও করতে দিচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার সকালে মাম্ব্রা উপজেলায় নির্মাণাধীন একটি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সরকারি বাহিনী। এ দিকে গত শুক্রবার রাত ১০টার দিকে সেনাবাহিনীর সহয়তায় বুচিডংয়ের লম্বাবিলে অক্ষত থাকা কয়েকটি বাড়িতে স্থানীয় রাখাইনরা আগুন দিয়ে চলে যায়। এতে কেউ হতাহত না হলেও রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এতে বাড়ির মূল্যবান আসবাবপত্রসহ বাড়ির প্রায় ৫০ ভাগই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এ অভিযোগ পাওয়া গেছে।

রোহিঙ্গারা যতটা না মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার তার চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার স্থানীয় মগ সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে। কারণে-অকারণে সুযোগ পেলেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাজেহাল করছে রাখাইন সন্ত্রাসীরা।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, মাম্ব্রা উপজেলার মিম্বিয়া এলাকার ছাম্বেলিপাড়ার রোহিঙ্গারা একটি পুরনো মসজিদ সংস্কারের কাজ করছিলেন। এ সময় অতর্কিতে প্রশাসনের লোকজন গিয়ে তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
এ দিকে গত বছরের ২৫ আগস্ট উত্তর রাখাইনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গণহত্যা ও জাতিগত নিধন চালালেও আকিয়াব, কিয়ক্ত, মাম্ব্রা ও তৎসংলগ্ন এলাকার রোহিঙ্গারা তুলনামূলক নিরাপদ ছিলেন। তবে ২০১২ সালের দাঙ্গায় এসব এলাকার রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছিল বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ও প্রশাসন। ওই সময় দাঙ্গার জেরে রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে আইডিপি ক্যাম্পে আটকে আছে এক লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। এরা শরণার্থীর মতো মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

গত আগস্টে রাখাইন রাজ্য সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হলে প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এভাবে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন অপারেশনে বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে বাস করছেন আরও পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। বর্তমানে সব মিলে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ভার বইছে বাংলাদেশ। এর পরও রোহিঙ্গা স্রোত এখনো অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গা বিতাড়নের পর সেনাবাহিনী উত্তর আরাকানে তাদের অবস্থান সুসংহত করার পর দেশের অন্যান্য রাজ্যেও নতুন নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন, টহল বৃদ্ধি ও অপারেশন চালাচ্ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর রাখাইন শান্ত থাকলেও রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে বা আকিয়াবসহ দক্ষিণাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানে রাখাইনে ন্যাশনাল কংগ্রেস বা এএনসির সশস্ত্র শাখা আরাকান আর্মির খুব প্রভাব রয়েছে।

আরাকানের স্বাধীনতা হারানোর ২৩৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে পুলিশের অনুমতি ছাড়াই র্যালি করতে গিয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাতজন। এ ঘটনার জেরে আরাকান বা রাখাইনের রাজধানী আকিয়াব বা সিতওয়েতে সংসদ ভবনের তিন দিকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি একযোগে বোমা হামলা চালানো হলে এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত সাতজন মগ বা রাখাইনকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে আটক করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আরাকান ন্যাশনাল কাউন্সিলের (এএনসি) একজন শীর্ষস্থানীয় নেতাও রয়েছেন।

আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের সাম্প্রতিক এক হিসাব মতে, মিয়ানমারের শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় বোঝাটি বহন করছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশেই রয়েছে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা। এখনো নতুন নতুন শরণার্থী আসছে। এ ছাড়া প্রতিবেশী মালয়েশিয়ায় প্রায় দুই লাখ, ভারতে প্রায় ৪০ হাজার, থাইল্যান্ডে ৫ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় এক হাজার রোহিঙ্গা অভিবাসী রয়েছেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর বাইরে পাকিস্তানে সাড়ে তিন লাখ, সৌদি আরবে দুই লাখ (কারো মতে পাঁচ লাখ) ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছেন। এসব দেশের বাইরে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডাসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে বাস করছেন আরও অর্ধলাখ রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা মুসলিম ছাড়াও মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খ্রিষ্টান অধ্যুষিত কারেন ও কাচিন অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষও এখন থাইল্যান্ড ও চীনে শরণার্থী হয়ে জীবনযাপন করছেন। ভিয়েতনাম ও লাওসেও রয়েছেন কয়েক হাজার শরণার্থী। এমনকি ভিন্ন মতের বুড্ডিস্ট রাজনীতিকেরাও শরণার্থী হয়েছেন জান্তার নির্যাতনে। মিয়ানমারে দীর্ঘ প্রায় ছয়-সাত দশক ধরে চলা সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে দেশত্যাগকারী মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। যারা প্রতিবেশী বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পরে স্থায়ী নাগরিক হয়ে ওই সব দেশের বোঝা বাড়িয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/301292