১০ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ১০:০১

আমদানি করা ৮৭ শতাংশ চাল গেলো কোথায়?

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে একের পর এলসি খোলা হচ্ছে। কিন্তু তাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। খোলা বাজারে ৩০ টাকায় চাল বিক্রি করলেও তার কোন প্রভাব নেই। দেশের প্রধান দুই খাদ্যশস্য চাল ও গমের উৎপাদন গত অর্থবছর কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর এ দুই খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছে ৩ শতাংশ। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই চাল ও গমের আমদানি বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। তাহলে প্রশ্ন হলো ৮৭ শতাংশ আমদানি করা চাল গেলো কোথায়?

আমদানি যে পরিমাণে বেড়েছে, তাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, হয় উৎপাদনের তথ্যে গরমিল আছে, তা নাহলে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে। অতিমাত্রায় এলসি খোলার কারণে বাজারে ডলারের দাম বেড়েছে। এতে করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে। এতে করে বেড়েছে কলমানি সুদের হারও। বেড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদ হার। একই সাথে আমানতের সুদ হারও বেড়েছে সমান তালে।

এমনিতেই চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে আমদানি বেড়েছে অস্বভাবিক হারে। আসলে এলসির নামে কোন পণ্য আদৌ আমদানি করা হচ্ছে কি না। নাকি শুধুই পাচার করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একাধিকবার উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। এমনকি অর্থমন্ত্রী বলেছেন নির্বাচনের বছর টাকার ছড়াছড়ি হবে। আর টাকার ছড়াছড়ি করতে এখন এলসির নামে বিদেশে টাকার পাচার হচ্ছে।
এলসি খোলা হলেও আসলে কোন পণ্য আনা হচ্ছে তার কোন কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। এতে করে সহজেই টাকা পাচার করা যাচ্ছে। একাধিকবার শুল্ক গোয়েন্দার হাতে এ চক্র ধরা খেলেই মূল হোতারা এখনও ধরা ছোয়ার বাহিরে রয়েগেছে। এতে করে ভুয়া এলসি কোনভাবেই কমছে না, পাচারও থামছে না।
গত বছর হাওড়ের বন্যায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতির কারণে চাল উৎপাদনে টান পড়ে। ব্লাস্টের কারণে কাক্সিক্ষত উৎপাদন হয়নি গমেরও। ফলে এ দুই খাদ্যশস্যের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর দেশে চাল ও গম উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৫১ লাখ টন। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ৫৭ হাজার টন। অর্থাৎ গত অর্থবছর প্রধান দুই খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছে সাড়ে নয় লাখ টন।

খাদ্যশস্যের এ উৎপাদন ঘাটতির মধ্যেই নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গার চাপ। তাদের পাশাপাশি দেশের বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্যচাহিদা পূরণে খাদ্যশস্যের আমদানি কিছুটা বাড়ার কথা থাকলেও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে দেশে চাল ও গম আমদানি হয়েছে ৬৮ লাখ ৪০ হাজার টন। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য দুটির আমদানি ছিল ৩৬ লাখ ৩৭ হাজার টন। অর্থাৎ সাড়ে নয় লাখ টন উৎপাদন ঘাটতির বিপরীতে অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩২ লাখ টন।

উৎপাদন ঘাটতি ও চাহিদার সঙ্গে আমদানির এ তথ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, উৎপাদন ঘাটতির সঙ্গে বাড়তি মানুষের প্রয়োজন যোগ করলে যে চাহিদা দাঁড়ায়, সাত মাসে তার চেয়ে বেশিই আমদানি হয়েছে। তাহলে হয় আমদানির তথ্যে, না হয় উৎপাদনের তথ্যে গরমিল আছে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি আমদানি হলে দেশে চালের বাজারে দাম কমার কথা। কিন্তু গত কয়েক মাসে সেটিও সেভাবে দেখা যায়নি। ফলে চাল আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দেয়া হচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে। পাশাপাশি উৎপাদনের তথ্যেও সঠিকতা আনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত আমদানি ব্যয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে শুধু চাল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্যটি আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৮৮ কোটি টাকা। আরেক প্রধান খাদ্যশস্য গম আমদানিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে খাদ্যশস্যটি আমদানি হয়েছিল ৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকার।

খাদ্যশস্য আমদানির এ পরিসংখ্যানে সন্দেহ জাগছে ব্যাংকারদের মধ্যেও। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, গত কয়েক মাসে বিপুল পরিমাণ চালসহ খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। তারপরও চালের বাজারে পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আসেনি। যে পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে, সে পরিমাণ চাহিদা না থাকলে এ বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য যাচ্ছে কোথায় সেটি দেখতে হবে।
গত অর্থবছর চালের উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণে জোর দেয়া হয়। চাল আমদানিতে আরোপিত ২৮ শতাংশ শুল্ক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। পাশাপাশি শূন্য মার্জিনে চাল আমদানিরও সুযোগ দেয়া হয় ব্যবসায়ীদের। এসবের ফলে পণ্যটির আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়।

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে নামিয়ে ২ শতাংশ করা হলেও এর কোন সুফল পায়নি দেশের সাধারণ জনগণ। ২৬ শতাংশ রেয়াতি শুল্কের পুরোটাই গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। সরকার যদি সময় মত চাল আমদানি করতে পারতো তাহলে আর চাল সিন্ডিকেটের পকেটে এ টাকা যেত না। কিন্তু সরকার গত বছরের মার্চ মাসে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) খাদ্য মন্ত্রণালয়কে আমদানি কথা জানালেও তারা সময় মত আমদানি করেনি। ফলে সরকারের খাদ্য ভান্ডারে মজুদ সংকট দেখা দেয়। আর এ সুযোগ কাজে লাগায় চাল সিন্ডিকেট। অসহায় সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে যতই কঠোর হয়েছে বাজার ততই বেড়েছে। এতে করে জনগণের পকেটের টাকায় চলে গেছে সিন্ডিকেটের পকেটে।

খাদ্যশস্য আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের মতো ঘটনা ঘটছে কিনা, জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল মাসুদ বলেন, চাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হলে তার দাম আন্তর্জাতিক তথ্যের সঙ্গে যাচাই করে দেখা হয়। এছাড়া পণ্য না দিয়ে জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে, এমন শঙ্কার কথা বিবেচনায় নিয়ে চার্টার্ড ভেসেল পরিহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি জাহাজগুলো পরীক্ষা করা হয়। ফলে মেশিনারি আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণার যে গুঞ্জন আছে, খাদ্যশস্য আমদানিতে তা বিন্দুমাত্রও নেই।
তবে আমদানির পরিমাণটা অস্বাভাবিক মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল। তিনি বলেন, আমদানির তথ্য যদিও সঠিকও হয়, সেক্ষেত্রে দেশে খাদ্যশস্যের বাড়তি মজুদ তৈরি হবে। ফলে সামনের বোরো মৌসুমে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য নাও পেতে পারেন। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন স্বপ্নই থেকে যেতে পারে।

জানা গেছে,বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আবারও খোলা বাজারে ৩০ টাকা দরে চাল বিক্রি শুরু করেছে। আর সারা দেশে আবারও ১০ টাকার দরে চাল বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে খাদ্যমন্ত্রণালয়। কিন্তু তাতে তেমন কাজে আসনি। বাজার চালের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম কমছে না।
চালের মওসুমে সরকার চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। মওসুমের পুরো চালই জনগণের হাতে রয়েছে। তাহলে কেন চালের দাম বাড়বে। আসলে বাজার চালের সিন্ডিকের এখনও স্বক্রিয় রয়েছে। সরকার কোনভাবেই এই সিন্ডিকেট ভাংতে পারছে না।

সরকার যদি এই সিন্ডিকেট না ভাংতে পারে তাহলে কোন উদ্যোগই কাজে আসবে না। সকল উদ্যোগই ভেস্তে যাচ্ছে। একদিকে সরকারকে সিন্ডিকেট ভাংতে হবে অন্যদিকে খাদ্য গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ আরও বাড়াতে হবে। তা না হলে বাজার কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং কমিটি থাকলেও তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজারে তাদের কোন তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এত কিছুর পরেও বাজার নিয়ন্ত্রণ না হওয়াতে জনগণ বেশ ক্ষুব্ধ।

 

http://www.dailysangram.com/post/321952