১০ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৯:৫৭

ঔদার্যের ডালি মেলে ধরে ভাড়ার খালি করছি

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : আমাদের প্রিয় বাংলাদেশসহ পাক-ভারত উপমহাদেশে অসংখ্য-অগণিত আরবি তথা পবিত্র কুরআনের শব্দ প্রচলিত আছে। এছাড়া উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, পশতু, পাঞ্জাবি ভাষারও অনেক শব্দ বাংলায় মিশে আছে। আরবিসহ হিন্দি, ফার্সি, উর্দু ভাষার সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের অনেকেরই গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। ভারতের বিরাট অংশজুড়ে যেমন হিন্দির রাজত্ব রয়েছে, তেমন পাকিস্তানেও উর্দুর সা¤্রাজ্য চলছে বলা যায়। ভারত ও পাকিস্তানে হিন্দি এবং উর্দুর সঙ্গে আরও বহু ভাষা বেশ দাপটেই চালু আছে। বাংলাদেশে উর্দু কিংবা হিন্দির প্রচলন না থাকলেও অনেকে হিন্দি ও উর্দু কিছুটা বোঝেন। এছাড়া আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে হিন্দি-উর্দুর প্রভাব তরুণদের মাঝে বেশ লক্ষ্য করবার মতো।

বলা যায়, বাংলাদেশে তরুণসমাজে বিশেষত হিন্দির আগ্রাসনই চলছে। তবে এনিয়ে আমাদের চেতনাজীবীদের তেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। তারা চিন্তিত বাংলাভাষার সঙ্গে যুগযুগান্তর ধরে কুরআন তথা আরবি ভাষার কিছু শব্দ মিশে থাকা নিয়ে। তারা তাই কুরআনের ভাষাকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করতে জানফানা করে দিতে প্রস্তুত।
বাংলাভাষায় অগণিত আরবি শব্দ ঢুকেছে। মিশে গেছে বাঙালির অস্থি-মজ্জায়। শুধু তাই নয়, বাংলাসহ আশপাশের আরও অনেক দেশের ভাষায় আরবি শব্দ ঢুকে একাত্ম হয়ে গেছে। বিশেষত বাংলাভাষীরা বুঝতেও পারে না যে, এগুলো আরবি বা বিদেশি শব্দ। যেমন: আল্লাহ্, রসুল , কিতাব, কুরআন, সালাম, কালাম, রহমত, নিয়ামত, কুদরত, খেয়ানত, আইন, আদালত, দলিল, দহলিজ, ফজিলত, মসজিদ, মাদ্রাসা, ইমাম, ঈমান, কিয়ামত ইকামত, ইবাদত, বরকত এরকম আরও অসংখ্য আরবি শব্দ সরাসরি বাংলাভাষায় একাত্ম রয়েছে যেগুলোকে এদেশের মানুষ কখনই বিদেশি মনে করে না। বরং এগুলোকে বাংলায় অনুবাদ করে চালু করতে চাইলে তা অনেকের কাছেই বিদেশি বা অচেনা ভাষায় পরিণত হবে।

আমাদের দেশের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ নাগরিক মুসলিম। এ বিপুল সংখ্যক মানুষ জন্মগতভাবে বাঙালি হলেও বিশ্বাসবোধ তথা ঈমান-আমানের দিক থেকে স্বতন্ত্র আদর্শের ধারক। এক আল্লাহ্ এদের রব বা ইলা। বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা:) এদের পথপ্রদর্শক। এরা মুসলিম বা আল্লাহর কাছে আত্মসর্পনকারী। প্রকৃত মুসলিমরা আল্লাহ্কে রব হিসেবে বিশ্বাস করেন। হযরত মুহম্মদ (সা:)কে নবী হিসেবে মানেন। এর বাইরে যাবার তাদের কোনও উপায় নেই। মুসলিমরা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন। রমযান মাসে সিয়াম পালন করেন। সামর্থ্যবানরা জীবনে একবার কা’বা শরিফ গিয়ে হজ সম্পন্ন এবং নিসাব পরিমাণ অর্থ জমা থাকলে বছরে একবার জাকাত প্রদান করেন। এগুলো মুসলিমদের অবশ্য করণীয়। এসবের অন্যথা করলে কেউ মুসলিম বলে নিজেকে দাবি করতে পারেন না। অবশ্য সালাত নেই, সিয়াম নেই, জাকাত দেবার মতো অর্থ থাকলেও তা আদায় করেন না এমন নামকা ওয়াস্তে মুসলিমের অভাব নেই এদেশে। ঠিক তেমনই সারা রমযান মাসে সিয়াম পালন করেন না একদিনও অথচ ঈদের কেনাকাটার ধূম পড়ে যায়। ভিড়ের চোটে সিয়াম পালনকারীরা বাজারে ঢুকতে পারেন না।
বলছিলাম, মুসলিমদের ভাষা হবে তাদের ঈমান, আকিদা মাফিক। একজন মুসলিম কখনও তার বিশ্বাসবোধের বাইরে গিয়ে কোনও ভাষা প্রয়োগ করতে পারেন না। যেমন: আল্লাহ্র কোনও প্রতিশব্দ নেই। হয় না। কোনও মুসলিম যদি আল্লাহ্র পরিবর্তে ভগবান, ঈশ্বর, খোদা, প্রভু, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করে বোঝাতে চান তাহলে হবে না। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টিসহ নানা সামাজিক সমস্যার সূচনা হতে পারে। তেমনই ঈমান, সালাত, সিয়াম, হজ, তাহরাত ইত্যাদি শব্দমালা দ্বারা যা বোঝেন তা অন্য শব্দমালা যেমন; বিশ্বাস, উপাসনা, উপবাস ইত্যাদি শব্দ দিয়ে সেগুলো বোঝানো মুশকিল। এছাড়া এমন শব্দান্তরে অর্থবিভ্রাট ঘটবার এবং ভুল বোঝারও অবকাশ থেকে যাবে। বাংলাদেশসহ আশপাশের প্রায় সবদেশের নিরক্ষর লোকও ঈমান, আমান, ইবাদত, সালাত, হজ, জাকাত, কিতাব, মসজিদ, মাদরাসা ইত্যাদি আরবি শব্দ বোঝেন। এমনকি অমুসলিমদেরও এসব আরবি শব্দ বুঝতে অসুবিধে নেই।
উদ্বেগের কারণ হচ্ছে অনেক বুদ্ধিজীবী, গায়ক-গায়িকা, লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক আল্লাহ্ শব্দ উচ্চারণ করতে চান না যদিও তারা নামে মুসলিম। আল্লাহ্ নামের মধ্যে তারা যেন সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা খুঁজে পান। তাই তারা আল্লাহ্ বলেন না। বলেন, সৃষ্টিকর্তা, ¯্রষ্টা, প্রভু। এইতো সেদিনও এক গায়িকা টিভিতে আল্লাহ্র স্থলে বললেন সৃষ্টিকর্তা। এমনটা শুধু একজন গায়িকা বা নায়িকা নন; প্রায়ই সবার মধ্যেই এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মানে আল্লাহ্ এই মহানাম যাতে ধীরে ধীরে এদেশের মানুষ ভুলে যায় সে উদ্যোগই নেয়া হয়েছে। আর এটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ।

দাদা-বাবারা মুসলিম। মা-দাদিরাও মুসলিম। আল্লাহ্ শব্দটা মুসলিমশিশুরা বংশানুক্রমে শেখে। প্রতিদিন মসজিদে সালাতের জন্য আযান হয়। সেখান থেকেও আল্লাহ্ শব্দ শুনে শেখে। কিন্তু সে শিশুরাই বড় হয়ে আল্লাহ্র স্থলে শেখে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু। এর মানে হচ্ছে আল্লাহ্ তথা মুসলিমদের ব্যবহৃত শব্দগুলো ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা চালানো হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। এছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও যুগযুগ ধরে মুসলিমদের ব্যবহৃত শব্দগুলো বাদ দিয়ে অমুসলিমদের ব্যবহৃত শব্দসমূহ বসানো হচ্ছে। এনিয়ে কথা হচ্ছে বটে। কিন্তু কেউ কান দিচ্ছেন না।
পাঠ্যবই, গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, ওডিও, ভিডিও, ফেসবুকসহ সবকিছু ব্যবহার করছে মুসলিমবিদ্বেষী সেক্যুলার সংস্কৃতির সেবাদাসরা খুব সতর্কতার সঙ্গে। এরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কালচারাল ইন্সটিটিউটগুলো প্রায় দখল করে নিয়েছে। তারা এখান থেকে বেতনভাতা নেয় আবার দেশের বাইরে থেকেও তাদের কাজের জন্য মোটা অংকের নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকে। এজন্য তারা বাপ-দাদার বুলি বাদ দিয়ে প্রভুদের শেখানো বুলি অনায়াসে আত্মস্থ করে নিয়েছে। আল্লাহ্ ছেড়ে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু ভগবান, ঈশ্বর ইত্যাদি বলবার এই হচ্ছে রহস্য। এছাড়া ‘খোদা’ শব্দটিও আরবি বা কুরআনের ভাষা নয়।
পৃথিবীতে লাখ লাখ জনগোষ্ঠী ও জনপদ বা তাদের নিজস্ব এলাকা আছে। তাদের স্বতন্ত্র ভাষাও আছে। প্রত্যেক ভাষায় যদি আল্লাহ্র মানে আল্লাহ্ শব্দের অনুবাদ হয় তাহলে অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছেন? স্রষ্টা, ক্রিয়েটর, গড, ঈশ্বর, প্রভু, ভগবান, পালনকর্তা, মারণকর্তা, ত্রাতা, রক্ষক, দয়াময়, করুণাময় এমন অসংখ্য অগণিত নামশব্দ পাওয়া যাবে। অথচ এগুলোর কোনও একটি শব্দ দিয়ে সঠিকভাবে আল্লাহ্ বোঝানো কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া আল্লাহ্র অনেক সিফাতি বা গুণবাচক নাম রয়েছে। আল্লাহ্ হচ্ছে তার জাত বা এবস্যুলিউট নাম। এ নামের ক্ষয় নেই। ভঙ্গুরতা নেই। আল্লাহ্র আর যতো নামই দেয়া হোক না কেন, কোনওটাই নিরঙ্কুশ বা নিত্যসত্তাবিশিষ্ট নয়। তাহলে কেন আল্লাহ্নাম বাদ দেবার মতো ধৃষ্টতা দেখাবে মানুষ?

আসলে আল্লাহ্ ও রাসূল (সা:) এর পথ বা আদর্শ থেকে সরিয়ে নেবার জন্য নানারকম আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। ফন্দিফিকির চলছে। বলা হচ্ছে, আরবিভাষা বিদেশি। তাই বেছে বেছে কুরআন তথা ইসলামী পরিভাষার শব্দগুলো বাদ দেয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলো বিকৃত করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর এ মহান (?) কাজে অবদান রাখছেন জন্মসূত্রে মুসলিমরাই। রেডিও-টিভি’র খবর পাঠেও চালানো হচ্ছে একই ‘শুদ্ধি অভিযান’। পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন অবশ্য অন্যরা। আমরা টের পাচ্ছি না। আমাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আমরা যেন ঔদার্যের ডালি মেলে ধরে আছি। ভাড়ার খালি হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।

http://www.dailysangram.com/post/322015