৯ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ৯:২১

উঠতি বয়সেই নিষ্ঠুর কেন

স্কুল থেকে ফিরে বাসার সামনে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল প্রথম শ্রেণির ছাত্র নাহিন আহমেদ (৭)। সেখান থেকে প্রতিবেশী মশিউর (১৮) তাকে ক্রিকেট খেলতে মাঠে নিয়ে যায়। কিন্তু ব্যাটে বল লাগাতে পারছিল না ছোট্ট নাহিন। করতে পারেনি কোনো রান। খেপে গিয়ে মশিউর ইট দিয়ে নাহিনের মাথা থেঁতলে দিলে মারা যায় সে। তারপর লাশ লুকানোর চেষ্টা। গত ২৪ জানুয়ারি বাড্ডা এলাকায় ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। এ রকম ‘খেলার ছলে’ একটি শিশুকে মেরে ফেলা সম্ভব এক তরুণের?
বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী জানান, ২৫ জানুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে মশিউর। তার দেওয়া তথ্যে আফতাবনগরের কাশবন থেকে নাহিনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
রাজধানীর নিউ পল্টন লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রনোর (১৮) বাবা শহিদ মিয়া কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন। রনো ও তার এক বোনকে নিয়ে কামরাঙ্গীর চরে বসবাস করছিলেন মা হেনা বেগম। বন্ধুদের সঙ্গে সময়-অসময়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেত রনো। গত ১ মার্চ বন্ধুরা তাকে শাঁখারীবাজারে হোলি উৎসবে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানেই রঙের উৎসবের মধ্যে তাকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। হত্যায় অংশ নেয় ১০-১২ জন, যারা প্রায় সবাই কমবেশি রনোর বয়সী। ফেসবুকের মাধ্যমে গড়া তার বন্ধু এরা! তবে সবাই ছাত্র নয়, কেউ ফলের দোকানে কাজ করে, কেউ কারখানার কর্মী। পুলিশ এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক ছাত্রীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ফেসবুকের এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার পর তাকে বাদ দিয়ে আরেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে রনো। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়েটিকে পছন্দ করত তার ফেসবুকের আরেক বন্ধু। এ নিয়ে বিরোধ, পরিণতিতে ছেলেটি খুন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জানে আলম মুন্সী বলেন, রনো ও আসামিরা ফেসবুক গ্রুপিংয়ের মাধ্যমে প্রেম ও বিরোধে জড়ায়। কারো কারো অভিভাবক নেই। কেউ অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ীতে মাতুয়াইল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ইমরান হোসেন মুন্নাকে (১৪) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তার সমবয়সী কয়েকজন। মোহাম্মদ শুভ, সুজন, সোহেল, রবিন ও শামীম নামে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এলাকাবাসী জানায়, প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাতুয়াইল চান্দিমাঠ এলাকায় ১০-১২ জনের বখাটে গ্রুপ আড্ডা দেয়। তারা মাদকে আসক্ত। মা-বাবার নিয়ন্ত্রণ নেই তাদের ওপর। বখাটে দলের মধ্যে বিরোধেই এই খুন হয়।

এভাবে অবলীলায় খুন-খারাবিতে মত্ত হয়ে উঠেছে উঠতি বয়সী তরুণরা। ২০টি ঘটনা নিয়ে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই ভয়াবহ চিত্র। খুন হচ্ছে খেলার জয়-পরাজয় নিয়ে, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে, প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে; বীরত্ব দেখাতেও খুনি হচ্ছে কিশোর-তরুণরা, গ্যাং গড়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়ছে তারা। সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে কিশোর-তরুণদের আদবকেতা শেখানো হচ্ছে না। অভিভাবকরা সন্তানদের সময় দেন না। অনলাইনের অন্ধকার জগতে মিশে যাচ্ছে অনেকে। তাদের ভাব-আবেগ ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে উঠছে না। ‘হিরোইজম’ বা নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি পুরনো। এর সঙ্গে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট মিলে কিশোর-তরুণরা নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আব্দুল হাকিম সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের ছেলে-মেয়েরা এখন গঠনমূলক নির্দেশনার মধ্যে বড় হচ্ছে না। ফেসবুকসহ সাইবার জগতের খারাপ দিকগুলোতে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে। সময়ের সঙ্গে অভিভাবকের উপযুক্ত যোগ্যতা এখন প্রশ্নের মুখে। আগে গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় বড়দের সালাম দিয়ে সম্মান করা শিখত ছেলে-মেয়েরা। এখন শহুরে জীবনে এসবের চর্চা নেই। বন্ধু বা পিয়ার গ্রুপে ওরা কী করছে, তা আমরা বুঝতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘ওরা স্কুল-কলেজ থেকে ফিরে একা মোবাইল ফেনে কোথায় চলে যাচ্ছে জানা যাচ্ছে না। কী করবে? নেই খেলার মাঠ, নেই সামাজিক অনুষ্ঠান। ওরা বুঝতে পারে না, কোনটা ভালো, আর কোনটা খারাপ।’
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, নিজেদের জাহিরে ‘অ্যাডভেনচারিয়াস’ বা ‘হিরোইজম’ থেকে উঠতি বয়সীরা অপরাধ করে। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দুর্বল হয়ে গেলে তরুণরা এভাবে অপরাধের দিকে অগ্রসর হতে পারে। আগে ছিন্নমূল সন্তানদের এমন অপরাধে বেশি দেখা যেত। এখন ভার্চুয়াল জগৎ বড় আর বাস্তব জগৎ ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে ভালো পরিবারের সন্তানটিও পরিবারের বন্ধনের বাইরে চলে যাচ্ছে। তার মধ্যে অপরাধবোধ ও মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে।’
গত বছরের ৬ নভেম্বর রায়েরবাগে শিপন (১৮) নামে এক তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে মিনহাজ, সজিব, আদনানসহ কয়েকজন। নিহতের আত্মীয় রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বখাটে চক্রটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল শিপন। এরা পরিবারের কোনো কথা শুনত না। কী নিয়ে এই হামলা তাই বুঝতে পারলাম না। তবে পুলিশ বলছে, সিনিয়র-জুনিয়র বিরোধেই খুন।’

গত ২৮ অক্টোবর চকবাজারে শিশু হাসপাতালের গলিতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হাসানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে সমবয়সী তিনজন। হাসানের বাবা আলী হোসেন বলেন, সিনিয়র-জুনিয়র বিতর্ককে কেন্দ্র করে তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় বখাটে একটি গ্রুপের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল তাঁর ছেলে।
গত বছরের ২৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর দারুস সালামের লালকুটিতে শাহিন (১৬) নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কয়েক কিশোর। শাহিনের মা সালেহা বেগম বলেন, টোলারবাগ ও লালকুটি এলাকার ছেলেরা ফুটবল খেলার আয়োজন করে। খেলায় শাহিনদের টোলারবাগ দল জয়ী হয়। বিষয়টি লালকুটির টিমের ছেলেরা মানতে পারেনি। বাসা থেকে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলে তার ছেলেকে। দারুস সালাম থানার ওসি সেলিমুজ্জামান বলেন, ডালিম নামে গ্যাং গ্রুপের এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। মূলত সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে শাহিনকে খুন করা হয়েছে। গত বছরের ২২ আগস্ট উত্তর পীরেরবাগে কবির হোসেন (২০) নামে এক প্রিন্টিং কারখানার কর্মী ছুরিকাঘাতে খুন হয়। তার ভগ্নিপতি আবু বকর সিদ্দিক গত বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কবির কাজ শেষে রাজু, মনিরসহ তিন-চারটা খারাপ ছেলের সঙ্গে আড্ডা দিত। সিনিয়র-জুনিয়ার নাকি অন্য কী নিয়ে যেন ঝামেলা হয়!’
গত ৫ অক্টোবর পল্লবীতে ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে হত্যা করা হয় ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মাহিম হাওলাদারকে। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মাহিম মামা আক্তার হোসেনের বাসায় থেকে পড়াশোনা করত। আক্তার হোসেন বলেন, রাত ১০টার দিকে মাহিমকে বাসার নিচে শিমুল, সজীব, সাজ্জাদ, সিয়াম, হৃদয়, ইমনসহ আরো কয়েকজন ছুরিকাঘাত করে। পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মঈনুল কবির বলেন, যারা হামলা করেছে ওরা বখাটে ছেলে।

৮ নভেম্বর রায়েরবাজারে খুন হন সাব্বির হোসেন (২৪)। এ ঘটনায় পাঁচ আসামি গ্রেপ্তার এবং দুজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই পীযূষ কুমার সরকার জানান, ছিনতাই করা একটি মোবাইল ফোন ও দুই হাজার টাকার জন্য সুবেল, পান্না, সোহেল, রাজু ওরফে শুভ, মিতা রুবেল, আলম, টুটুল ওরফে চাচা ও সাব্বির বাবু এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। রায়েরবাজারের সচিববাড়ির গলির ডা. গোলাম সারোয়ারের একমাত্র ছেলে সাব্বির। ভালো পরিবারের সন্তানটি এসএসসি পাস করে বখাটেচক্রের সঙ্গে মিশে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছিল পরিবার। বোন সালমা জাহান বলেন, ‘সাব্বির মাঝেমধ্যে রাতে বাসায় আসত না। কিভাবে খারাপ পথে গেছে জানি না।’
২১ নভেম্বর যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজ মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে কাওছার আহমেদ (১৭) নামের এক কিশোর নিহত হয়। পুলিশের ভাষ্য, নিহতসহ যারা এই খুনে জড়িত সবাই নেশাখোর ও বখাটে। সন্ধ্যার পর আবাসিক এলাকায় উচ্ছৃঙ্খল আড্ডা, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক নেওয়া, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেওয়া, পাড়ার মোড়ে মোড়ে হৈ-হুল্লোড় করা এবং জোরে হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেল চালানো শহুরে তরুণ-কিশোরদের অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে।

গত বছরের ২০ মে যাত্রাবাড়ীতে ফ্যান কারখানার কর্মী জাহিদুল হাওলাদার (১৬), ২ মার্চ শেওড়াপাড়ায় সজীব মিয়া (১৭), ২ জুলাই শেখেরটেকে সজল (১৫), ১৮ জানুয়ারি তেজকুনীপাড়ায় আবদুল আজিজ (১৬) এবং ১৫ জানুয়ারি রূপনগরে কামাল হোসেন (১৭) নামে এক কিশোর সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে খুন হয়। গত বছরের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় স্কুলশিক্ষার্থী আদনান কবির খুনের পর নগরীতে কিশোর-তরুণ গ্যাং গ্রুপ আলোচনায় উঠে আসে। র্যা ব ও পুলিশ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। এখনো ‘ডিসকো বয়েজ’ এবং ‘নাইন স্টার বয়েজ উত্তরা’র ফেসবুক পেজের স্ট্যাটাসের শেষে চশমা, পিস্তল, ছুরি, হাতবোমা ও সিগারেটের ইমোজি ব্যবহার করে তারা।
গত ২ ডিসেম্বর মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতার ৩২৪ নম্বর এ-৮ ফ্ল্যাটে সরদার সুজা আহমেদ এবং ১৪ আগস্ট মিরপুরে ঢাকা কলেজের ছাত্র আল-আমিন মাহমুদ বিজয়কে হত্যা করে মাদকাসক্ত বন্ধুরা।

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/03/09/611084