৯ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ৯:১১

মুসলিমদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি ভয়াবহ বৌদ্ধদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সেনাবাহিনী

শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে মুসলিমদের ওপর হামলা ও সহিংসতা ঠেকাতে আরো সৈন্য নিয়োজিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। পুলিশ দাঙ্গা থামাতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হামলাকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সিনহালারা বিভিন্ন মসজিদ এবং মুসলিমদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছিল। মুসলমানদের সাথে বিবাদকে কেন্দ্র করে একজন বৌদ্ধ তরুণের মৃত্যুর খবরে তারা কারফিউ উপেক্ষা করে এসব হামলা চালায়।

মসজিদ ও মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর একের পর এক হামলার পর দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। পরে কারফিউর মেয়াদও বাড়ানো হয়। দেশটির কর্তৃপক্ষ সামাজিক মাধ্যম ব্লক করে দিয়েছে।
মঙ্গলবার ক্যান্ডিতে একটি পুড়ে যাওয়া বাড়ির ভেতর থেকে এক মুসলিম তরুণের লাশ পাওয়ার পর থেকে সেখানে আবারো সঙ্ঘাত শুরু হতে পারে এমন আশঙ্কা করে কর্তৃপক্ষ।
নতুন করে সহিংসতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনহালা সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে রাতভর সংঘর্ষ চলে বেশ কিছু এলাকায় বৌদ্ধরা মুসলিমদের বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
বুধবার ক্যান্ডি শহরে হাতবোমা বহনের সময় সিনহালা সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সেই সাথে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারি মুখপাত্র রাজিথা সেনারাথানে।
এ দিকে এই দাঙ্গার ঘটনাকে ঘিরে সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা টুইট বার্তায় এ ধরনের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, শ্রীলঙ্কায় জাতিগত বা ধর্মীয় অবস্থানের কারণে কোনো মানুষ হামলা বা হুমকির শিকার হতে পারে না। সেখানে বর্ণবিদ্বেষ বা সহিংসতার কোনো স্থান নেই। সবাইকে জোরালোভাবে একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

যেভাবে শুরু দাঙ্গা
মধ্যাঞ্চলীয় ক্যান্ডি শহরে সপ্তাহখানেক আগে গাড়ি সংক্রান্ত এক বিরোধের জেরে মুসলিমদের হাতে এক বৌদ্ধ তরুণ মারা গেছে। এ রকম একটি খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানে উত্তেজনা দেখা দেয়। এর পর থেকে আমপারে শহরে মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদে হামলা চালানো হয়।
কিছু কিছু এলাকায় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সিনহালারা মুসলিমদের মালিকানাধীন দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সোমবার সেখানে পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিলে কারফিউ জারি করা হয়।
কিন্তু পরে সেটি কিছু সময়ের জন্য তুলে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২৪ বছর বয়সী এক মুসলিম তরুণের লাশ উদ্ধার হওয়ার সাথে সাথেই সেখানে আবার সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মসজিদ, বাড়িঘর, দোকান এবং গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়।

স্থানীয় একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, মুসলিমদের ‘সবকিছু ভেঙে ফেলা হয়েছে, তারা এখন সেখানে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে।’
মঙ্গলবার বৌদ্ধদের দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি বাড়ির পাশে মুসলিম এক তরুণের লাশ উদ্ধারের পর সেখানে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতি আরো সঙ্ঘাতময় হতে পারে এই আশঙ্কায় ১০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ছাড়াও ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যারা এ ধরনের সহিংসতায় উসকানি দেবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
২০১২ সালের পর থেকে শ্রীলঙ্কায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। কট্টরপন্থী একটি বৌদ্ধ গ্রুপ বিবিএসের বিরুদ্ধে উত্তেজনায় উসকানি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

ক্যান্ডির পরিস্থিতি শান্ত, সাময়িকভাবে কারফিউ প্রত্যাহার
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, কয়েক দিন ধরে বৌদ্ধদের সাথে সংখ্যালঘু মুসলিমদের দাঙ্গার পর শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি শহরে জারি করা কারফিউ সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
গতকাল সন্ধ্যার পর কারফিউ ফের বহাল করা হতে পারে বলে এক সামরিক কর্মকর্তার বরাতে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
গত রোববার শহরটির দুই সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে ঝগড়ার জেরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। বৌদ্ধ দাঙ্গাকারীরা একটি মসজিদ ও মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে।
দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা।
তবে গত বুধবার রাতে ও গতকাল সকালে ক্যান্ডির পরিস্থিতি শান্ত ছিল বলে জানিয়েছে সামরিক বাহিনী।
মেজর জেনারেল রুকমান ডিয়াস বলেছেন, ‘পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। গত ১২ ঘণ্টায় কোনো বড় ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।’

সন্ধ্যায় ক্যান্ডিতে ফের কারফিউ বহাল হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।
শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছিল কয়েকটি কট্টরপন্থী বৌদ্ধ গোষ্ঠী। পাশাপাশি বৌদ্ধ পুরাতাত্ত্বিক স্থানগুলো ভাঙচুরের জন্যও মুসলমানদের দায়ী করে আসছিল তারা।
গত বছরের শেষে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার থেকে মুসলমান রোহিঙ্গারা শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় নিতে শুরু করলে তাতে আপত্তি জানিয়ে প্রতিবাদ শুরু করে দেশটির কয়েকটি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী।
এসব নিয়ে দেশটিতে এ দু’টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এ রকম এক পরিস্থিতিতেই ক্যান্ডিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ১০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে ও দাঙ্গার উসকানি রোধ করতে তিন দিনের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটঅ্যাপ ব্লক করে দেয়।
তারপরও বুধবার কারফিউ চলার মধ্যেই ক্যান্ডিতে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণে একজন নিহত ও আরো তিনজন আহত হন।
শ্রীলঙ্কার দুই কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৯ শতাংশ মুসলিম। জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ১৩ শতাংশ তামিল যাদের বেশির ভাগই হিন্দু।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/300129