রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অসুস্থ এক শিশু
৯ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ৯:১০

আসিয়ান রিপোর্ট

রাখাইনে ৪৩ হাজার রোহিঙ্গা বাবা-মা নিখোঁজ

নিহত বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের

নতুন এক মানবাধিকার রিপোর্টে বিপুল রোহিঙ্গা হত্যার আলামত মিলেছে। আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস (এপিএইচআর) নামের কমিটির ওই মানবাধিকার রিপোর্ট বলছে, গত আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ নির্মম দমনাভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গা শিশুর ৪৩ হাজার বাবা-মা নিখোঁজ রয়েছেন। তারা নিহত হয়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দণি-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর পার্লামেন্ট সদস্যদের নিয়ে গঠিত এপিএইচআর বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো জরিপের ভিত্তিতে নতুন ওই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এ খবর প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম টাইম।
জরিপের ফলাফল প্রমাণ করে রাখাইনে নিহতের সংখ্যা মিয়ানমার কর্তৃপরে স্বীকার করা সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাখাইনে গত আগস্ট থেকে মাত্র চার শ’ মানুষের নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে মিয়ানমার কর্তৃপ।

নিরাপত্তাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর গত বছরের আগস্টের শেষ সপ্তাহে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ নির্মম দমনাভিযান শুরু করে মিয়ানমার। নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের বয়ানে উঠে আসতে থাকে রাখাইনে স্থানীয়দের সাথে নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংসতার চিত্র।
এই বছরের ২১ থেকে ২৪ জানুয়ারি এপিএইচআর বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে তদন্তমূলক অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধান শেষে দেয়া রিপোর্টে বাংলাদেশের সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২৮ হাজার তিন শ’ রোহিঙ্গা শিশু নিজেদের বাবা-মায়ের কমপে একজনকে হারিয়েছে। এছাড়া শিবিরের সাত হাজার সাত শ’ শিশু বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে। আর এই দুই সংখ্যা মিলিয়ে রোহিঙ্গা শিশুর নিখোঁজ হওয়া বাবা-মায়ের সংখ্যা ৪৩ হাজার সাত শ’।

এপিএইচআরের রিসার্চ ও অ্যাডভোকেসি পরিচালক অরেন সামেত টাইমকে বলেছেন, ‘এই সংখ্যক রোহিঙ্গা শিশুর বাবা-মা তাদের সাথে নেই। কারণ হয় তাদের হত্যা করা হয়েছে, অথবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে আশঙ্কা রয়েছে না হয় তারা কোথায় রয়েছেন তার কোনো সন্ধান নেই।’ আগে ধারণা করা হতো বাংলাদেশের অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরগুলোয় দুই হাজার ৬৮০ জন রোহিঙ্গা শিশু বাবা-মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। তবে এপিএইচআরের জরিপে পাওয়া তথ্য জানাচ্ছে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইনে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়াদের সংখ্যার বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান নেই। ওই অভিযানকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ আখ্যা দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। ডক্টরর্স উইদাউট বর্ডারস নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ধারণা অভিযানের প্রথম এক মাসের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ছয় হাজার সাত শ’ রোহিঙ্গা।

আরেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফরর্টিফাই রাইটসের কর্মকর্তা ম্যাথিউ স্মিথ বলেছেন নিখোঁজ বাবা-মায়ের সংখ্যা রাখাইনে চলমান নৃশংসতাকে উন্মোচন করা শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর ল্যবস্তু হওয়া এলাকার প্রত্যদর্শী ও বেঁচে ফেরাদের কাছ থেকে পাওয়া যেসব তথ্য আমরা নথিভুক্ত করতে পেরেছি তাতে দেখা যায়, নিখোঁজ এসব বাবা-মায়েদের বড় অংশই হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সাল এবং আগস্টের পর থেকে আক্রমণের শিকার হওয়া তিনটি শহরতলিতেই নির্বিচার হত্যা ও গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে।’

এপিএইচআরের সভাপতি ও মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট সদস্য চার্লস সান্তিয়াগো বলেন, আমরা অনেক শিশুকে পেয়েছি যাদের বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে। পথচারী অথবা প্রতিবেশীরা জ্বলন্ত ঘর থেকে তাদের উদ্ধার করে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে নিয়ে এসেছে। জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা বলছে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো সম্ভাব্য মানব পাচারের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। সান্তিয়াগো বলেন, আমার আশঙ্কা বর্ষা মওসুম শুরু হলেই মানব পাচার শুরু হবে। মানুষ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ছাড়াও যেখানে পারে সেখানেই যেতে চাইবে।
এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি রাখাইনে পাঁচটি গণকবর থাকার তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে। সেসব প্রত্যদর্শীর ধারণা সহিংসতার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা গু দার পাইন এলাকায় নিহতের সংখ্যা পুরো সঙ্কটে মিয়ানমার কর্তৃপরে দাবি করা সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। মার্কিন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের ডেপুটি পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, মিয়ানমার সরকারের নিহতের সংখ্যা চার শ’ দাবি করা একটি খারাপ মশকরা। নিজেদের তদন্ত চালানোর কথা ব্যবহার করে তারা নৃশংসতার ঘটনায় আরো স্বাধীন তদন্তের প্রয়োজনীয়তাকে আড়াল করতে চায়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/300134