৯ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ৯:০৮

আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা সময়ের দাবি

হারুন-আর-রশিদ
দেশের আর্থিক খাতগুলোতে কয়েক বছর ধরে চরম মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। একই সাথে বাংলাদেশের ১৪টি সেক্টর করপোরেশনে মন্দাবস্থা বিরাজমান। স্বাধীনতার আগে ১২টি সেক্টর করপোরেশন লাভজনক অবস্থায় ছিল। বাংলাদেশ জুট করপোরেশন কখনোই অলাভজনক ছিল না। বাংলাদেশে মাত্র দুই বছর ছাড়া বাকি ৪৪ বছর এই খাতটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। শেষ অবধি ১৯৯৬-২০০১ বিএনপি সরকারের আমলে আদমজী বন্ধ করে দেয়া হয়, যাকে প্রাচ্যের ডান্ডি বলে উপাধি দেয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সুনামধারী এই প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে এখন সেখানে নির্মিত হচ্ছে শাসকদলের পছন্দনীয় কিছু প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ বলছে এটা এখন দখলের তালিকায়। পাট, চিনি, চামড়া, ইস্পাত, বন, বিমান, সড়ক ও যোগাযোগ, সেনাকল্যাণ সংস্থাÑ কোনোটিই এখন লাভের খাতায় নেই। বাংলাদেশের উন্নয়ন শুধু বিলবোর্ড, সরকারি দলের মুখে এবং গণমাধ্যমে এর প্রচার চলছে। বাস্তবে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্য দিকে, দেশে বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে রেখেছে। যেমন- পোশাক শিল্প, হস্তশিল্প, সিরামিক পণ্য, ওষুধ শিল্প, বাইসাইকেল ইত্যাদি খাতে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। রফতানি বাণিজ্যকে টেকসই করতে হলে পণ্যবহুমুখী করার পাশাপাশি ভৌগোলিক বহুমুখীকরণ একান্ত প্রয়োজন। বিগত দশকে রফতানি বাণিজ্যে আমাদের অন্যতম অর্জন এই বহুমুখীকরণ। বহুমুখীকরণ খাতে গত এক দশকে দেশের রফতানি আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। ১৯৯০-২০০০ সাল পর্যন্ত যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের ঘরেই ওঠানামা করত। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশে। পোশাক শিল্পের রফতানি দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত শিল্পের বিকাশ রফতানি খাতে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করছে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশে তৈরী ঢাকাই জামদানি সমাদৃত, যার নকশার নান্দনিকতা তুলনাহীন। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি খুচরো দোকানে বিক্রির জন্য শোভা পায় এ দেশের তৈরী সিরামিক্স পণ্য। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে আমাদের ওষুধ শিল্প। বিশ্ববাণিজ্যে আমাদের চা-এর চাহিদাও ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশে তৈরী বাইসাইকেল এখন ইউরোপের বাজারে শীর্ষ পাঁচটির মধ্যে একটি।
হস্তশিল্প : বাংলাদেশে হাতে তৈরী নকশিকাঁথা, মাটির তৈরী তৈজসপত্র, শীতলপাটি ও মুসলিম বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে রফতানি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের প্রথম ভূতাত্ত্বিক ইস্পাত (জিআই) পণ্য হিসেবে জামদানি স্বীকৃতি পেয়েছে। জামদানি কার্পাস তুলা দিয়ে প্রস্তুত একধরনের বস্ত্র, যার বুনন পদ্ধতি অনন্য এবং ইউনেস্কো থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃত। ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে জামদানি রফতানি হয়ে থাকে।
সিরামিক পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এটি একটি ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খাত। বাংলাদেশ থেকে প্রধানত ডিনারসেট, স্যানিটারি সামগ্রী ও টাইলস রফতানি হয়। ওষুধ শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বিকাশমান শিল্প, বাংলাদেশের তৈরী ওষুধ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশে রফতানি হয়। বাইসাইকেল সম্ভাবনাময় রফতানি খাত হিসেবে ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে তৈরী বাইসাইকেল বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে। ইউরোপের ২৫টির বেশি দেশে বাংলাদেশ বাইসাইকেল রফতানি করে। বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে উৎকৃষ্ট মানের চা উৎপাদন ও রফতানি করে আসছে (সৌজন্য-প্রাইম ব্যাংক ২০১৮ বর্ষ সংখ্যা)।

আমরা পিছিয়ে গেছি দেশের ব্যাংক খাতে। এখানে চরম মন্দা বিরাজ করছে কয়েক বছর ধরে। এক দিকে তারল্য সঙ্কট, অন্য দিকে হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের ভারে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছে ব্যাংকিং খাত। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এই মুহূর্তে মূলধনের ঘাটতি ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দু’টি বিশেষায়িত ব্যাংকেই মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। ব্যাংক পরিচালনায় বিদ্যমান অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলবাজি, পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের ঘটনাগুলোকে চিহ্নিত করে এর একটা সুরাহা না করে এবং মূলধন পুনরুদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার বদলে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় লুণ্ঠিত মূলধনের ঘাটতি মেটানোর সিদ্ধান্ত কতটা সঙ্গত এ প্রশ্ন উঠেছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মূলধন সঙ্কটের পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তহবিল সঙ্কটে পড়েছে।
কিছু দিন আগেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অলস টাকার সঙ্কটে পড়ে ঋণ ও আমানতের সুদের হার কমিয়ে দিয়েছিল। এখন সুদের হার বাড়িয়েও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলধনের ঘাটতি মেটাতে পারছে না। এ সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় বহু দিন ধরে বড় ধরনের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও তহবিল তসরুপের বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারিতার ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দুই বছর আগে অর্থমন্ত্রী ক্ষোভ ও অসন্তোষের কথা বলেছেন। শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করে বসে থাকলে চলবে না- এ সঙ্কটের সুষ্ঠু সমাধানের পথ বের করতে হবে। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ম.খা আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক এবং অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের হাতে জনতা ব্যাংকে দেশের বৃহত্তম একক ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য পত্রিকায় বের হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা ও নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বেনামি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে জনতা ব্যাংককে বিপদগ্রস্ত করে তোলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী নিজেও আবুল বারকাত জনতা ব্যাংক শেষ করে দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যেখানে অনুদানের দুই কোটি ১০ লাখ টাকা অনিয়মের অভিযোগে মামলা দিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে জেলে পাঠানো হচ্ছে। যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সাথে জড়িতরা বছরের পর বছর ধরে কোনো জবাবদিহিতার বাইরে থাকছে। এসব কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতের জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না। দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতি, নিরাপত্তাহীনতা, লাগামহীন লুটপাট ও দুর্নীতির কারণে বিগত এক দশকে দেশ থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কিভাবে, কোন কৌশলে এসব টাকা পাচার হয়েছে তার ফিরিস্তি বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। দেশের ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতেও বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো নিয়ে বিশ্লেষণসহ করণীয় বিষয় নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছে, এসব সমস্যা ত্বরিত সমাধানে এগিয়ে না এলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে চরম নৈরাজ্য দেখা দেবে।

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ একটি জাতীয় দৈনিকে লিড নিউজ ছিলÑ ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। গ্রাহক তুলে নিচ্ছে আমানত। সুদের হার বাড়িয়ে আমানতকারীদের ফেরানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে শিল্পোদ্যোক্তারা। এ কারণে বিনিয়োগ কমানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পত্রিকায় উঠেছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য জাপান সরকারের অর্থায়নে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করবে ২৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে ২৪ প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার ‘ফরেন পাইরেক্ট ইনভেস্ট প্রমোশন প্রজেক্ট (বিডি-পি ৮৬) চুক্তির আওতায় সাত হাজার ১০৯ জাপানি ইয়েন বা ৪৬১ কোটি ৬২ লাখ টাকা বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে এ ঋণ বিতরণ করবে। ঋণ গ্রহণে অগ্রাধিকার দেয়া হবেÑ দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প পার্ক প্রতিষ্ঠাকারীদের।

২০১৭ সালের জরিপে দেখা গেছেÑ বেসরকারি ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে ১৩টির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক বেড়েছে। সব ব্যাংকেই যেন সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। নামে-বেনামে ইচ্ছা মতো অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে। ঋণে বেড়েছে অনিয়ম। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একাধিকবার ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এমনকি জাতীয় সংসদেও একাধিকবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যাংক খাত। এ দিকে ব্যাংক মালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত ‘গ্লোবাল কম্পিটিভনেস রিপোর্ট ২০১৭-১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অস্থিরতার চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয় ৫১ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন ব্যাংক খাতে অনিয়ম রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন কমানো হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বড় আকারের মন্দ ঋণ আদায় হচ্ছে না। বড় বড় কোম্পানির কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এ দিকে ব্যাংক আমানতের সুদের হার ব্যাংক ঋণের সুদের হারের তুলনায় কমেছে, উদাহরণস্বরূপ অগ্রণী ব্যাংক আমানতের সুদের হার ৪ দশমিক ৫০ থেকে ৫ শতাংশ হারে দিচ্ছে, পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার নিচ্ছে ১১ থেকে ১২ শতাংশ হারে। আমানতকারীরা সুদ কম পাচ্ছেÑ অন্য দিকে ঋণ গ্রহণকারীর কাছ থেকে ব্যাংক সুদ বেশি নিচ্ছে। এ কারণে ডিপোজিট হোল্ডাররা নিরুৎসাহী আর ঋণ গ্রহণকারীরা ঋণ নিয়ে পরে তা মন্দ ঋণের খাঁচায় আবদ্ধ হচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। সুদের হার কম হওয়ায় আমানতকারীরাও ব্যাংকে টাকা রাখছেন না। এ ছাড়া আবগারি শুল্ক বেড়েছে। লভ্যাংশের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কর্তন ছাড়াও নানা খাতওয়ারি আমানতকারীদের হিসাব থেকে টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে। ব্যাংক খাতের এসব জটিলতা অনেক বছর ধরে চলছে। ফলে পুঁজিবাজারেও ব্যাংকখাত ভালো করছে না। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের একটি সংস্কার প্রয়োজন, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক সহায়তায় সম্ভব বলে আমরা মনে করি। হ
harunrashidar@g.m.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/300102