শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্টে মঙ্গলবার রাতে আসা রোহিঙ্গারা
৮ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৫

রোহিঙ্গাশূন্য হচ্ছে রাখাইন

প্রতিদিনই পালিয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা; সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাটহল জোরদার

মিয়ানমার সরকার রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে যে সেনা অভিযান শুরু করেছিল তা অব্যাহত রয়েছে। চালানো হচ্ছে নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন। ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া দূরের কথা, রাখাইন থেকে প্রতিদিনই শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে এতদিন টিকে ছিলেন তারও চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে অচিরেই রোহিঙ্গাশূন্য হতে যাচ্ছে রাখাইন। এ দিকে সীমান্তেও শক্তি বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার।

ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য বাংলাদেশের সাথে চুুক্তি স্বাক্ষরের পর যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ঠিক তখনই মিয়ানমার নতুন করে রাখাইনেও সেনা অভিযান শুরু করে। উত্তেজনা সৃষ্টির লক্ষ্যে সীমান্তে সেনা ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন করে। বিষয়টি নিয়ে গত শুক্রবার বিকেলে ঘুমধুম সীমান্তের মৈত্রী সেতু এলাকায় বিজিবি এবং বিজিপির মধ্যে দেড় ঘণ্টা পতাকা বৈঠক হয়। এরপর সীমান্তে উত্তেজনা কমে আসে। কিন্তু এক দিন পর রোববার থেকে আবারো নাফ নদীর ওপার ও তুমব্রু সীমান্তে আবারো সেনা মোতায়েন করে মিয়ানমার।
মঙ্গলবার ভোর রাতে নৌকায় শাহপরীর দ্বীপের ঘোলার চর পয়েন্ট ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সাবরাং হারিয়াখালী পয়েন্ট দিয়ে ঢুকেছে ৩৪টি পরিবারের ৯৫ জন রোহিঙ্গা। তারা রাখাইনের কিজিংগি পাড়া, পুইমালী ও বুচিডং এলাকা থেকে এসেছেন। সীমান্তের ওপারে ঢংখালী চরে আরো হাজার খানেক রোহিঙ্গা এপারে পালিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন বলেও জানান তারা।

শাহপরীর দ্বীপের ঘোলার চর পয়েন্ট দিয়ে আসা রাখাইনের বুচিডং এলাকার রোহিঙ্গা হোসেন জুহার (৪১) বলেন, ‘আমরা নিজের দেশ ছেড়ে কোথাও পালাতে চাইনি, তাই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ আগে থেকে বাংলাদেশ চলে এলেও কঠিন পরিস্থিতিতেও আমরা রাখাইনে থেকে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেনারা রোহিঙ্গাদের খুঁজে খুঁজে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশ পালিয়ে যেতে বলছে। আমরা অস্বীকৃতি জানালে তারা আমাদের কঠিন পরিণতির কথা বলে হুমকি দিচ্ছে। তাই আমরা নিরূপায় হয়ে চলে এসেছি।
জুহার বলেন, নিজের দেশে সুখের বসবাস ছিল আমাদের, সেখানে আমাদের কমবেশি সম্পদ-খ্যাতি ছিল, নিজেদের সম্পদ থেকে আমরা গ্রামের লোকদের দান-সাহায্য করতাম, গত ছয় মাসের পরিস্থিতি বাদ দিলে আমরা সেখানে রাজকীয় জীবনযাপনই করতাম কিন্তু এ দেশে আমরা সে সুখ শান্তি, ধন-সম্পদ কোনো দিনই পাব না, এরপরও সব কিছু হারিয়ে অন্তত প্রাণে বাঁচতে এখানে পালিয়ে এসেছি। তবে শান্তি ফিরলে পুনরায় রাখাইনে যাবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা রাখাইনে সীমান্তজুড়ে অতিরিক্তি সেনা সমাবেশের কথাও বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, ঢংখালী সীমান্তের কাঁটাতারের গেট সংলগ্ন এলাকায় বিপুল সেনা সমাবেশ তাদের চোখে পড়েছিল, এমনকি সেনারা তাদের আটকে রেখে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে রোহিঙ্গারা সেখানে থাকবে না, বাংলাদেশে চলে যাবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

পুইমালীর রোহিঙ্গা বৃদ্ধা নুরজাহান বলেন, আমরা সেখানে চলতে ফিরতে পারছিলাম না, থেকে যাওয়ার বহু চেষ্টা করে আমাদের জীবন দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। মিয়ানমার সেনারা আমাদের ঘর থেকে বের হতে দেয় না, ক্ষেত খামারেও যেতে দেয় না, এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ওষুধের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছিল না। অনাহারে অর্ধাহারে অনেক দিন কাটিয়েছি, এরপরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় এ দেশে চলে এসেছি।
এ দিকে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের রোহিঙ্গা আবদুল মতলব বলেন, তুমব্রু সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা ও ভারী অস্ত্রের সমাবেশ ঘটানোর পর এবার টেকনাফের নাফ নদীর তীরে মিয়ানমার সীমান্তে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী বড় বড় গাড়ি নিয়ে রাত-দিন টহল দিচ্ছে।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নুর আলম (৫৫) জানান, রোববার সন্ধ্যায় ৫০ জনের একটি দল বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য মংডুর হাসসুরাতা রওনা দেয়। পথে তারা দেখতে পান সারি সারি গাড়ি টহল দিচ্ছে। পরে দলটি এলোমেলো হয়ে যায়। তার মধ্যে ১০ জনের একটি দল মিয়ানমার সীমান্তে পৌঁছায়। এরপর তারা নৌকায় নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আসে। বাকিরা কে কোথায় জানা নেই।
তারা আরো জানান, শেষ পর্যন্ত যারা ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে থেকে যেতে চেয়েছিলেন, তারাও এখন পালিয়ে আসছেন। তবে রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না সেনাবাহিনী। যারা ঘর থেকে বের হতে চায়, তাদের ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেলেও আবার ধরা পড়ার আতঙ্ক ছাড়ে না।
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবদুর রশিদ বলেন, মিয়ানমারে এখনো যে রোহিঙ্গারা রয়ে গেছে তাদের তাড়ানোর জন্য আবার আরসা খোঁজার নাটক করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের খাঁচায় বন্দী পাখির মতো করে রেখেছে সেনারা। ফলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/299865