৮ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৮

যখন সরকারের গুরুত্ব কমে যায় জনগণের কাছে

‘মহাসড়ক মানেই মহাদুর্ভোগ’ শিরোনাম থেকেই উপলব্ধি করা যায় আমাদের মহাসড়কের হাল-হকিকত। ৩ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) অধীন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-সেতু মেরামত ও নির্মাণে গত আট বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এরপরও সড়কের বেহাল অবস্থা বদলায়নি। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কের স্থানে স্থানে খানাখন্দক, সড়কপথে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়েছে। জেলা ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। জোড়াতালির মেরামত, পরক্ষণেই গর্তÑ এই চক্রেই চলছে গত আট বছর। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৭ অনুযায়ী এশিয়ার মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট সড়কের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। কেবল নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। আর সওজের হাইওয়ে ডিজাইন ম্যানুয়াল (এইচডিএস) বিভাগের ২০১৬ সালের আগস্টের প্রতিবেদন অনুসারে দেশের ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক খারাপ। ৩৯ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভাল। আর সাড়ে ২৩ শতাংশ চলনসই। এরপর তারা গত নভেম্বরে নতুন করে জরিপ শুরু করেছে। এর প্রাথমিক ফল অনুযায়ী সড়ক-মহাসড়কের অর্ধেকই খারাপের পর্যায়ে চলে গেছে। এর মধ্যে খুলনা অঞ্চলের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের সড়কের অবস্থাও খারাপ।
সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থা নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। বহু সচিত্র প্রতিবেদনও আমরা দেখেছি। আশ্বাস বাণীও আমরা শুনেছি। এরপরও ফলাফল হলো এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ নিকৃষ্ট সড়কের দেশ। শুধু নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। গত আট বছরে সওজ যে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করলো তার ফলাফলটা এমন হলো কেন? সড়ক নির্মাণের পর তা টানা ১৫ বছর কোনরকম মেরামত ছাড়াই ভালো থাকবেÑ এটা ধরে নিয়েই নকশা করার রীতি রয়েছে দেশে। এরপর টুকটাক মেরামত করে ২০ বছর পর পুনঃনির্মাণ করার কথা। অথচ বাংলাদেশে নির্মাণের পরের বছর থেকেই মেরামতের দরকার পড়ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র সড়ক ব্যবস্থাপনা এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, নির্মাণের ২০-২৫ বছর পর্যন্ত হাত দিতে হয় না। এরপর টুকটাক মেরামত করে সড়কের বয়স ৪০ বছর পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ক’দিন পরপর মেরামত করার এই প্রবণতাকে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক অভিহিত করেছেন উন্নয়নের ‘ব্ল্যাকহোল’ বা অন্ধকূপ হিসেবে। এটা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না, সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। তিনি মনে করেন, তিন করণে এত দ্রুত মেরামতের দরকার পড়ছে। যেমন : ১. নির্মাণ ও মেরামতে গলদ, ২. অতিরিক্ত মালবাহী যান চলাচল, ৩. দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা।
নির্মাণ ও মেরামত গলদের কারণ হচ্ছে- রাজনৈতিক ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্যে প্রকৃত ঠিকাদাররা কাজ পান না। আর রাজনৈতিক ঠিকাদারদের কাছ থেকে মানসম্পন্ন কাজ আদায় করা যায় না। ফলে প্রকৌশলীরাও ঠিকাদারদের সঙ্গে সমঝোতার পথেই হাঁটেন, কাজের মান সম্পর্কে খুব একটা প্রশ্ন তোলেন না। সরকার ই-টেন্ডারিং চালু করলেও তাতে কাজ হচ্ছে না। কারণ, এক জেলার কাজ অন্য জেলা বা দূর থেকে কেউ করার সাহস পান না। প্রাণের মায়াতো সবারই আছে। আর কেউ দূর থেকে কাজ পেলেও তাকে চাঁদা বা কমিশন দিতে হয়। ফলে কাজ সঠিক হয় না। ওভারলোডিং বা অতিরিক্ত মালবাহী যান চলাচলের বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নিজেই ২২ টন (পেছনের চাকায়) মাল বহনের অনুমতি দিয়েছে। এটা একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন অধ্যাপক শামছুল হক। এছাড়া দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণেও সড়ক ভাঙছে। বাংলাদেশের সড়কগুলো বিটুমিনের। পানি আর বিটুমিন পরস্পরের শত্রু। ফলে কোন সড়কে পানি জমে থাকলে সড়ক ভাঙবেই। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক কংক্রিট ঢালাইয়ে নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে বর্ষার বা পানির প্রভাব পড়বে না। এই ব্যবস্থায় খরচ সামান্য বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কমে যাবে। বিশেষজ্ঞদের এইসব মতামতকে সরকার গুরুত্ব দিলে ভাল হয়। জনগণকে দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালিত না হলে সরকার ও কর্তৃপক্ষের গুরুত্ব কমে যাবে জনগণের কাছে।

উন্নয়নের ব্ল্যাকহোলের মতো সরষের ভিতরে ভূতও কারো কাম্য নয়। এ জন্যই ‘সরষের ভেতরই ভুত’ কথাটির বেশ প্রচলন রয়েছে আমাদের সমাজে। এক্ষেত্রে আর একটি উদাহরণ যোগ করলেন মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা। ২ মার্চ তারিখে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, নিজেরা মদ খেয়ে গাঁজাসহ গ্রেফতার দুই সন্দেহভাজনকে নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একজন সেপাই ও একজন সোর্স। থানায় তাঁদের মাতলামিতে পুলিশের সন্দেহ হয়। পরে পুলিশ তাদের আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের খবর দেয়। কর্মকর্তারা তাঁদের সহকর্মীদের মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিলেও সোর্সের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার রাতে খুলনার বটিয়াঘাটা থানায়। কর্তব্য পালনের সময় মদ খাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত দু’জন হলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর খুলনার এস আই মনোজিৎ কুমার বিশ্বাস ও গোয়েন্দা শাখার সেপাই মো. সেলিম।

ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ) আতিকুল হক ১ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকেলে আমাদের কাছে খবরটি এসেছে। আমরা বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছি।’ এদিকে পুলিশ জানায়, এসআই মনোজিৎ, সেপাই সেলিম ও তাদের সোর্স সুশীলকে হাসপাতালে নিয়ে ‘স্টমাক ওয়াশ’ করানো হয়। হাসপাতালের দেয়া সনদের ভিত্তিতে সোর্সের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জেলা কর্মকর্তারা থানায় এসে পুলিশকে জানান যে, তাঁদের দুই সহকর্মীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপর আটক দুইজনকে মুচলেকা নিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের জিম্মায় দেওয়া হয়। মুচলেকায় তাঁরা উল্লেখ করেন, তাঁরা মদ খেয়েছিলেন, এরপরে আর কোনোদিন এমন করবেন না।

আমরা জানি, মদ বা মাদকদ্রব্য গ্রহণ অন্যায় কাজ, আর ডিউটিরত অবস্থায় যদি তা করা হয় তাহলে তো অন্যায়ের মাত্রা বেড়ে যায়। যারা মাদক নিয়ন্ত্রণ করবেন তারাই যদি এমন উদাহরণ সৃষ্টি করেন, তাহলে মাদকচর্চা নিয়ন্ত্রিত হবে কেমন করে? মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে এমনিতেই চাপের মুখে রয়েছে সংস্থাটি। ২৮ জন মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সঠিকভাবে তাদের কাজ না করায় এবং অভিযোগ থাকায় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিকে ঢাকার মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ নিজের সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কেউ মাদকে জড়ালে চাকরি থাকবে না। কোনো সংস্থাকে কার্যকর রাখতে এ ধরনের হুঁশিয়ারি কিংবা প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে নৈতিক শিক্ষা ও নৈতিক মান বজায় রাখার বিষয়টিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটি সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।

http://www.dailysangram.com/post/321754