৭ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৮:৪৪

আইএমইডি’র প্রতিবেদন

১২০টি প্রকল্পে একটি টাকাও খরচ হয়নি

রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প গ্রহণের খেসারত * ৮৪ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি শূন্য

রাজনৈতিক বিবেচনায় গৃহীত ১২০টি উন্নয়ন প্রকল্পে একটি টাকাও ব্যয় করা হয়নি। বরাদ্দ থাকলেও পুরো অর্থবছরে কোনো অর্থই খরচ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের শুরু থেকে ৮৪ প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতিও শূন্য। এটি এডিপির মোট প্রকল্পে ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। প্রকল্প তদারকি সংস্থা ‘বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)’ গত অর্থবছরের (২০১৬-১৭) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করে এ ভয়াবহ চিত্র পেয়েছে। গত মাসে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করেছে সংস্থাটি। এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা না হলেও সার্বিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির ২১টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।
টাকা ব্যয় না হওয়ার ঘটনাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প হাতে নেয়ার খেসারত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, যে কারণেই হোক এমনটা মেনে নেয়া যায় না। এটা অবশ্যই আর্থিক ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী। ফলে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যেমন পিছিয়ে যাচ্ছে, তেমনি পরবর্তীতে ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এসব প্রকল্পের সুফল প্রাপ্তি থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, অধিকাংশই নতুন প্রকল্প এবং সময়মতো অর্থ বরাদ্দ না মেলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব মো. মফিজুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, গত অর্থবছরে এ রকম প্রকল্প পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরে যোগাযোগ করা হলে বিস্তারিত জানানো যাবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক কারণসহ বিভিন্ন বিবেচনায় অতিরিক্ত প্রকল্প গ্রহণ করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা উন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত করে। এটি আর্থিক ও শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এ কারণে এক দিকে যেমন প্রকল্পের সুফল পাওয়া যায় না, অন্যদিকে ব্যয় বৃদ্ধি পায়।

সূত্র জানায়, চিহ্নিত করা ১২০টি প্রকল্পের মধ্যে গত অর্থবছরের এডিপিতে ১১৮ প্রকল্পের অনুকূলে ৭৭২ কোটি ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি প্রকল্পে ৩৬০ কোটি টাকা সর্বোচ্চ বরাদ্দ রয়েছে। ৩৮টি প্রকল্পে সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ ছিল। বরাদ্দের বিপরীতে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প (৩১টি) রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগে। এরপর পর্যায়ক্রমে গৃহায়ন ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৯টি প্রকল্প, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১০টি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাতটি, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাতটি, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ছয়টি, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চারটি, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চারটি, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তিনটি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তিনটি, শিল্প মন্ত্রণালয়ের তিনটি, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তিনটি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দুটি, সেতু বিভাগের দুটি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, কৃষি, বাণিজ্য, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি করে প্রকল্প রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পটি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দুই হাজার ৪২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা মোট ব্যয় ধরা হয়। এ প্রকল্পের অনুকূলে গত অর্থবছরের এডিপিতে ৩৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এর বিপরীতে এক টাকাও খরচ হয়নি। একই অবস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের বরিশাল-ভোলা-বোরহানউদ্দিন ২৩০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন প্রকল্পেও। এটি ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় মোট ৪৫৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত অর্থবছর বরাদ্দ ছিল ৩৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু কোনো অর্থই ব্যয় হয়নি। এ ছাড়া ডিজাইন সাপ্লাই, ইনস্টলমেন্ট, টেস্টিং অ্যান্ড কমিশনিং অব থ্রি নাম্বার অব ১৩২/৩৩ কেভি পাওয়ার ট্রান্সমিশন শীতলক্ষ্যা-ধানমণ্ডি অ্যান্ড কামরাঙ্গীরচর সাব-স্টেশন প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ৩৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। কিন্তু কোনো টাকা ব্যয় হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের দু-একটি প্রকল্প রয়েছে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে (আইডিবি)। দরপত্রের প্রক্রিয়ার বিষয়ে ঝামেলা থাকায় টাকা ব্যয় করা যায়নি। তবে এ অবস্থা সাধারণত বেশির ভাগ নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে হয়েছে। এটা স্বাভাবিক বিষয়। তিনি আরও বলেন, সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন গত অর্থবছরের চেয়ে অনেক ভালো হচ্ছে। গত অর্থবছরে একটি টাকাও ব্যয় না হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকার আজিমপুরে জজদের জন্য সুউচ্চ আবাসিক ভবন নির্মাণ, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প, এনজিও ব্যুরোর অফিস ভবন নির্মাণ, আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর উন্নয়ন, পারকি ও পতেঙ্গাতে পর্যটন উন্নয়ন, ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্ট, রেলওয়ের চিনকি-আস্তানা-আশুগঞ্জ সেকশনের উন্নয়ন, ২০০টি মিটারগেজ প্যাসেঞ্জার বগি সংগ্রহ, সৈয়দপুর ও বরিশাল বিমানবন্দরের উন্নয়ন, পশুর চ্যানেলের আউটার ড্রেজিং এবং বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, কর্ম ও ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন না করা, প্রকল্প তদারকি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সক্ষমতার অভাব, ভূমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, প্রকল্প পরিচালদের দক্ষতার অভাব, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে দরপত্র প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন সহযোগীদের মতামত পেতে বিলম্ব এবং প্রকল্প চলাকালে অভ্যন্তরীণ অডিড না হওয়া ইত্যাদি।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/24864