৭ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৮:৪৩

ঘাটে ঘাটে ঘুষ বাণিজ্য

উৎকোচ ছাড়া বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা করে না * ম্যানুয়ালি দেয়া হয় ফ্লাইট সিডিউল * দুপুরের পর টাওয়ারের সিগন্যাল পাওয়া যায় না * কার্গো ফ্লাইটের আড়ালে চলছে ইয়াবা পাচার * ঘুষ ছাড়া উন্নয়ন কাজের মালামাল ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয় না


ঘুষ ছাড়া কক্সবাজার বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা করে না। বন্ধ থাকে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। উন্নয়ন কাজের মালামাল বিমানবন্দরের ভেতরে নিতেও ঘুষ দিতে হয়। অন্যথায় গেট খোলার অনুমতি মেলে না। ঘুষ না দেয়ায় বিমানবন্দরের রানওয়ে সংস্কার, নতুন রানওয়ে নির্মাণসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ থমকে আছে বলে অভিযোগ উঠেছে ।

সিডিউল ফ্লাইটের জন্য ঘুষের রেট কিছুটা কম হলেও নন সিডিউল ফ্লাইটে ঘুষ লেনদেন হয় মার্কিন ডলারে। ম্যানুয়ালি ফ্লাইট সিডিউল দেয়ার কারণে ঘুষ ছাড়া কেউ সিরিয়াল পায় না। দুপুরের পর টাওয়ারের সঙ্কেত না পাওয়ায় ম্যানুয়ালি কাজ চালানো হয়। এ সুযোগে ঘুষ লেনদেন হচ্ছে।
মাছের পোনা বহনকারী কার্গো ফ্লাইটগুলোতে ঘুষের রেট আকাশচুম্বী। কারণ এসব ফ্লাইটে পোনার কনটেইনারে গোপনে পাচার হচ্ছে ইয়াবা। মাছের পোনা ব্যবসার নামে এই পথে ইয়াবা পাচার করে গত পাঁচ বছরে কোটিপতি হয়েছেন মৎস্যজীবী মোস্তাক আহমদ ওরফে মফিজ। কিছু দিন আগে ইয়াবা চোরাচালানের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় এই মোস্তাক। এই পাচারের সঙ্গেও জড়িত আছে রাঘববোয়ালের সিন্ডিকেট। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগ আছে এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের প্রত্যয়ন ছাড়া সিভিল এভিয়েশন সদর দফতর থেকে কোনো ধরনের অর্থ ছাড় করা হয় না। ছোট বড় প্রতিটি কাজেরই প্রত্যয়ন লাগে সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক ও সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের। আর এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রতিটি কাজের প্রত্যয়নের জন্য বিমানবন্দরের অসাধু কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরে অনিয়ম ঘুষ লেনদেনের খবর আমাদের কাছেও এসেছে। আমরা বিমানবন্দরের স্টেশন ম্যানেজারকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। দুর্নীতি প্রমাণিত হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে উন্নয়ন ও নতুন রানওয়ে-টেক্সিওয়ে নির্মাণ কাজের মালামাল বিমানবন্দরের ভেতরে নেয়ার জন্য বড় অঙ্কের ঘুষ দাবি করা হয়। দাবি পূরণ না হওয়ায় দীর্ঘদিন মালামাল বিমানবন্দরের বাইরে বিভিন্ন গেটে আটকে ছিল। এ ঘটনায় এয়ারপোর্ট ম্যানেজার সাধন কুমার মোহন্তের বিরুদ্ধে অভিযোগও করা হয় সিভিল এভিয়েশন সদর দফতরে। বিষয়টি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তার নজরে আনা হয়। ওই কর্মকর্তা এয়ারপোর্ট ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও তাদের অবিলম্বে ওই স্টেশন থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেন। কিন্তু ওই নির্দেশ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগ আছে কক্সবাজার বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের একটি উন্নতমানের রেস্টহাউস আছে। সিন্ডিকেট এই রেস্টহাউস ভাড়া দিয়ে আয়কৃত টাকা সংস্থার কোষাগারে জমা দেন না। এ নিয়ে এয়ারপোর্ট ম্যানেজারকে এক দফা সতর্ক করা হলেও তাকে ওই স্টেশন থেকে বদলি করা হয়নি। মাছের পোনা বহনকারী ফ্লাইটগুলো ম্যানুয়ালি অনুমতি দেয়ার কারণে প্রতিটি ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণে সিন্ডিকেটকে ঘুষ দেয়ারও অভিযোগ আছে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার বিমানবন্দরের এয়াপোর্ট ম্যানেজার সাধন কুমার মোহন্ত যুগান্তরকে বলেন, ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ সঠিক নয়। তবে বিষয়টি তিনিও শুনেছেন বলে জানান। সদর দফতরের সদস্য পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা তাকে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। ঘুষের কথা বলেননি। তবে জানতে চেয়েছেন ঠিকাদারদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিচ্ছি কিনা। তিনি বলেন, বিমানবন্দরের একজন ঠিকাদারের মালামাল ভেতরে প্রবেশ নিয়ে কিছু দিন আগে নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। এরপর সেটা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর সঙ্গে কোনো ধরনের ঘুষ লেনদেন হয়নি। রেস্টহাউস ভাড়া নিয়েও কোনো অনিয়ম হচ্ছে না।
কার্গো ফ্লাইটে ইয়াবা পাচার করতে গোপন লেনদেন : সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের কলাতলীর কাটা পাহাড় এলাকা থেকে পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী মোস্তাক আহমদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে। পুলিশের ভাষ্য মতে, ইয়াবা চোরাচালানের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় মোস্তাক। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে মাছের পোনা বহনকারী ফ্লাইটে ইয়াবা পাচারের ভয়াবহ চিত্র। পুলিশ এ ঘটনায় একজন এয়ারপোর্ট ম্যানেজার, একটি কার্গো এয়ারলাইন্স মালিক, দুই বিদেশি পাইলট, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক রাশিয়ান নাগরিক ও স্থানীয় কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার সঙ্গে জড়িত সিভিল এভিয়েশনের ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নজরদারির আওতায় এনে তদন্ত করছেন। অভিযোগ আছে এসব ইয়াবা হাতবদল হয়ে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রুদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাচার হতো। গত সপ্তাহে এই অভিযোগে বাংলাদেশ বিমানের দুই কেবিন ক্রুকে আটক করেছে রিয়াদ পুলিশ। রিয়াদের হোটেল রেডিসন ব্ল– থেকে তাদের আটক করে স্থানীয় পুলিশ। কক্সবাজার থেকে মাছের পোনা বহনকারী ফ্লাইটগুলোর মাধ্যমে এসব ইয়াবা তাদের কাছে আসত।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই বিমানবন্দরে ভয়াবহ মাত্রায় ঘুষ লেনদেন হয়। ঘুষ দিলে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশনের আইন কানুনকেও বৃদ্ধাঙ্গুল দেখায় এই বিমানবন্দরের সংঘবদ্ধ চক্রটি। আইনের তোয়াক্কা না করে এখান থেকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ কার্গো ফ্লাইটগুলোকেও নানা কৌশলে উড্ডয়নের অনুমতি দেয়া হয়। সে ক্ষেত্রে ফ্লাইটপ্রতি উড্ডয়নের জন্য ৫০০ থেকে ৭০০-৮০০ ডলার ঘুষ দিতে হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়ে পরিচালিত এয়ারক্রাফট আকাশে ওড়ার অনুমতির ক্ষেত্রে ঘুষের রেট হাজার ডলারও ছাড়িয়ে যায়। এভাবে ঘুষ দিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে কক্সবাজার থেকে মাছের পোনা বহনকারী অভ্যন্তরীণ বেশ ক’টি কার্গো উড়োজাহাজ। এয়ারপোর্ট সংশ্লিষ্ট কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কিছু অসাদু চিংড়ি ব্যবসায়ীর শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সহায়তায় এ রুটে ব্যবসা চালাত তিন-চারটি বিমান সংস্থা। বর্তমানে দুটি সচল আছে। একটি এয়ারলাইন্সের অধিকাংশ উড়োজাহাজই লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা। কিছু উড়োজাহাজ ৩০-৩৫ বছরের পুরনো। অভিযোগ আছে ঘুষের বিনিময়ে কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ উড়োজাহাজগুলো আকাশে ওড়ার অনুমতি দিচ্ছে।

২০১৬ সালের মার্চে কক্সবাজার বিমানবন্দরের পাশে একটি এয়ারক্রাফট (এএন-২৬) বিধ্বস্ত হয়। পরে তদন্তে দেখা গেছে এয়ারক্রাফটির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট (যন্ত্রাংশ) ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। অভিযোগ আছে, উড়োজাহাজটির একটি ইঞ্চিন বছরের অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকত। তার পরও এটি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে কক্সবাজার-যশোর রুটে মাছের পোনা বহন করা হতো। আর এর ফাঁকে চালাত ইয়াবা ব্যবসা। জানা গেছে, সংস্থাটির একই মডেলের দুটি এয়ারক্রাফট আছে। একটির যন্ত্র নষ্ট হলে দ্বিতীয়টি থেকে ওই যন্ত্রটি খুলে লাগানো হতো। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এটি মারাত্মক অপরাধ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব যন্ত্রাংশ স্থানান্তরের সময় সিভিল এভিয়েশনকে জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও মালিকপক্ষ তা করত না। এ ক্ষেত্রে এয়াপোর্ট ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্টদের ঘুষ দিয়ে ফ্লাইট চালানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, উড়োজাহাজটির (পাওয়ার কাট-পিসি) ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার যন্ত্রটিও প্রায়ই বিকল থাকত। ফলে অনেক সময় কর্তৃপক্ষ মানুষ ভাড়া করে ধাক্কা দিয়ে ইঞ্জিন চালু করেছে। এখনও একটি কার্গো এয়ারক্রাফটের এক্সচুয়েটর ফুয়েল কক মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও সংশ্লিষ্টদের আশীর্বাদে সেটি ওঠানামা করছে। একটি এয়ারক্রাফটের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র সুইচ টেম্পারেচারটিও প্রায়ই নষ্ট থাকে। একটি উড়োজাহাজ ল্যান্ড করার পর জাহাজ থেকে মবিল পড়ে রানওয়ে নষ্ট হয়ে গেলেও সংশ্লিষ্টরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

বিমানবন্দর দিয়ে ইয়াবা পাচারের কথা স্বীকার করেন এয়ারপোর্ট ম্যানেজার সাধন কুমার মোহন্থ। তিনি বলেন, এটা বিমানবন্দরের কিছু করার নেই। এটা ধরার দায়িত্ব কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। তারপরও প্রতিনিয়ত ফ্লাইট থেকে ইয়াবা আটকের কথা স্বীকার করেন তিনি। কার্গো ফ্লাইটে মাছের পোনার সঙ্গে ইয়াবা পাচারের সম্পর্কে তিনি বলেন, তার যোগদানের আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থাও এ নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিল। ওই রিপোর্টে কোনো ধরনের তল্লাশি কিংবা স্ক্যানিং ছাড়া কার্গো ফ্লাইট আসা-যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলেও তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, মাছের পোনায় স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে স্ক্রিনিং করা হলে তেজস্ক্রিয়তার কারণে পোনা মারা যাচ্ছে বলে মালিকরা অভিযোগ করেন। তারপর থেকে স্ক্যানিং বন্ধ আছে। ফ্লাইট ওঠানামায় ঘুষ নেয়ার বিষয় সঠিক নয়। কার্গো এয়ারক্রাফটগুলোর অনেক কম্পোনেন্ট মেয়াদোত্তীর্ণ, লক্কড়-ঝক্কড় ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে উড্ডয়ন অবতরণ করছে। এ কারণে ফ্লাইট উড্ডয়ন অবতরণের সময় মালিকদের ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা তিনি দেখেন না। এর দায়িত্ব পরিচালক ফ্লাইট সেফটি বিভাগের।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন উইং কমান্ডার জিয়াউল কবীর যুগান্তরকে বলেন, কিছু দিন আগে একটি কার্গো ফ্লাইট কক্সবাজারে বিধ্বস্ত হয়েছিল। তদন্তে কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে কাজ চলছে। কার্গো ফ্লাইটগুলো দিয়ে শুধু মাছের পোনা বহন করা হচ্ছে। এয়ারক্রাফটগুলোর কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ আছে কিনা তা তিনি তদন্ত করে দেখবেন বলে জানান।

কার্গো ফ্লাইটগুলোর সিডিউল ম্যানুয়ালি করা হচ্ছে কেন? এ প্রসঙ্গে ফ্লাইট সেফটি বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, টাওয়ার না থাকার কারণে এটা হচ্ছে। বর্তমানে দুপুরের পর কক্সবাজার বিমানবন্দর টাওয়ারে ধরা পড়ে না বলে ম্যানুয়ালি করা হয়। যদি কোনো কর্মকর্তা এর সুযোগ নিয়ে ঘুষ বাণিজ্য করে তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/24852