৭ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৮:৪২

গাবতলী টু বাবুবাজার বেড়িবাঁধ

সাড়ে ১১ কিলোমিটার রাস্তায় ১৬টি পয়েন্টে চাঁদাবাজি

চালবোঝাই ট্রাক নিয়ে গাবতলী থেকে বেড়িবাঁধে ঢুকতেই হাতের ইশারায় ট্রাক থামাতে হয় রাসেলকে। গাড়িটি থামার সাথে সাথে ডান পাশে এসে দাঁড়ায় এক যুবক। হাতে ছোট্ট একটি লাঠি। রাসেলের কাছে এক শ’ টাকা দাবি করে। কিসের টাকা জানতে চাইলে ধমক দেয় লাঠিধারী ওই যুবক। ‘এত্তো কথা বলিস ক্যান। টাকা চাইছি, টাকা দিয়া যা গা’। বাধ্য হয়ে রাসেল পকেট থেকে এক শ’ টাকা বের করে দেয়। রাসেলের বক্তব্য, বগুড়া থেকে ঢাকায় আসতে আরো অন্তত ১০টি স্পটে চাঁদা দিতে হয়েছে। গাবতলী হয়ে নয়াবাজার যেতে আরো ১৫টি স্পটে রাসেলকে টাকা গুনতে হয়েছে। এভাবেই ঢাকা শহর রক্ষাবাঁধের গাবতলী থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার রাস্তায় গণ পরিবহনসহ বিভিন্ন যানবাহনে দেদার চাঁদাবাজি চলছে। ডিএমপির ৮ থানা ও ফাঁড়ির কিছু অসৎ পুলিশ সদস্য এবং চিহ্নিত মাস্তানরা চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতার বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ উঠেছে। চাঁদাবাজির কারণে দিন-রাত শহর রক্ষা বাঁধে যানজট লেগেই থাকছে।
রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমে শহর রক্ষা বাঁধের পুরান ঢাকার মিটফোর্ড বাবুবাজার থেকে গাবতলীর দূরত্ব ১১ দশমিক ৬০ কিলোমিটার। দীর্ঘ এ পথে প্রতিদিন ১০ হাজারের বেশি পণ্য ও যাত্রীবাহী গাড়িসহ বিভিন্ন পরিবহন চলাচল করে। নগরীর তীব্র যানজট এড়াতে দ্রুততম সময়ে পুরান ঢাকার আদালত চত্বর, শিক্ষা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পাইকারি কাপড়, মাছ-ফলের আড়তসহ বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছতে পরিবহন মালিক-চালক ও যাত্রীরা দীর্ঘ এ পথ নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করেন। এ পথ দিয়ে প্রতিদিন দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে নগরীর ঐতিহ্যবাহী পাইকারি মার্কেট মৌলভীবাজার, বাবুবাজার, ইসলামপুর প্রবেশ করছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্র জানায়, শহর রক্ষা বাঁধে সাভার টু বাবুবাজার (ভায়া গাবতলী) রুটে সর্বমোট ৯০টি বাস প্রতিদিন চলাচল করছে। প্রতিটি গাড়ি গড়ে ৫-৬ বার যাওয়া আসা করে। এ ছাড়া গাবতলী টু হাজারীবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ রুটে ফিটনেসহীন হিউম্যান হলার বেশ কিছু লক্কড়-ঝক্কড় মিনিবাস, মোহাম্মদপুর টু নবাবগঞ্জ সেকশন রুটে সরকার নিষিদ্ধ শ’ খানেক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার টু নবাবগঞ্জ সেকশন রুটে অর্ধশতাধিক সিএনজি অটোরিকশা, নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ টু মিটফোর্ড বাবুবাজার রুটে নিয়মিত প্রায় ৩০টি লেগুনা ও বাবুবাজার ব্রিজের ওপর-নিচ থেকে জুরাইন, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীসহ ১০টি রুটে প্রায় ৩ শ’ যাত্রীবাহী পরিবহন চলাচল করছে। অপর দিকে এ পথে প্রতিদিন পণ্যবাহী সহ¯্রাধিক ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শহর রক্ষা বাঁধে গাবতলী থেকে মিটফোর্ডের বাবুবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ দশমিক ৬০ কিলোমিটার পথ ডিএমপির ৮টি থানার অধীনে থাকায় সংশ্লিষ্ট থানা-ফাঁড়ির কিছু পুলিশ ও শাসকদলের কথিত নেতাকর্মী এবং চিহ্নিত চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছেন পরিবহন মালিক-চালক ও শ্রমিকেরা। লালবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন টু মিটফোর্ডের বাবুবাজার রুটের লেগুনা থেকে ৪ থানার কিছু সদস্য ও ফাঁড়ি পুলিশ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট এলাকার কিছু জনপ্রতিনিধি এবং শাসক দলের কথিত নেতাকর্মীরা গড়ে প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকার চাঁদা তুলছেন। এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে প্রতিদিন দেড় হাজার টাকা দিতে হয়। কয়েকদিন আগেও তিনি নিতেন এক হাজার টাকা করে। এখন রেট বেড়েছে। অপর এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে দিনে ৩০টি লেগুনা থেকে দিতে হয় ৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া ইসলামবাগের কথিত এক যুবলীগ নেতা এসব লেগুনা থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ আছে। পরিবহন কাউন্টার থেকে স্থানীয় কিছু পুলিশ ও আনসার সদস্যদের নামে প্রতিদিন ৯ শ’ টাকা হারে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া বংশাল ও কোতোয়ালি থানাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার দুই ফাঁড়ির কিছু পুলিশের জন্য গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় হচ্ছে। এ ছাড়াও ব্রিজের নিচে অবৈধ ফুটপাথের দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন মালিক বলেন, কিছু পুলিশ আর মাস্তান মিলে সমানে চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা দিতে না চাইলে রাস্তায় গাড়ি আটকে রাখে তারা। কামরাঙ্গীরচরের লোহারপুলসহ কয়েকটি এলাকায় রীতিমতো রাস্তায় যানবাহন আটকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে পোশাক পরিহিত অবস্থায় পুলিশ প্রকাশ্যে অর্থ আদায় করছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেলের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেছেন, চাঁদাবাজি যেই করুক না কেন এটা একটা অপরাধমূলক কাজ। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/299614