৭ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৮:৩৭

আগরতলা ও খাটের তলার গল্প

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : গত ৩ মার্চ বিকালে সিলেটের শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক ড. জাফর ইকবালের ওপর গুরুতর হামলা হয়েছে। ধারালো ছোরা দিয়ে তার মাথায়, পিঠে ও বাহুতে ছয়টি আঘাত করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি মাথায়, একটি পিঠে ও একটি বাহুতে। একটি অনুষ্ঠান মঞ্চে হামলাকারী ফয়জুর রহমান জাফর ইকবালের ঠিক পেছনে, যেখানে পুলিশদের দাঁড়িয়ে থাকার কথা, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই যখন মুক্ত মঞ্চের সামনের ভলিবল গ্রাউন্ডে রোবফাইটে মনোযোগী ছিলেন, তখনই ফয়জুর জাফর ইকবালের ওপর এই প্রাণঘাতী হামলা চালায়। ছয়টি আঘাত মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে করে বসেছিল। তারপর তাকে চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে গণপিটুনি দেয় এবং মরণাপন্ন অবস্থায় তাকে ক্যাম্পাসেরই একটি কক্ষে আটকিয়ে রাখে। ড. জাফর ইকবালকে প্রথমে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার করেন। সেখানকার ডাক্তাররাও বলেছিলেন জাফর ইকবাল আশঙ্কামুক্ত। কিন্তু সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা করে এবং জাফর ইকবালকে রাতেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়। সেখানে একটি মেডিক্যাল বোর্ড তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। তারাও জানান যে, জাফর ইকবাল আশঙ্কামুক্ত।

ড. জাফর ইকবালের ওপর এই বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। এবং চাই যে, এই ঘাতকের পেছনে কারা আছে, কি তাদের উদ্দেশ্য সে সম্পর্কে দেশবাসীকে তদন্ত করে জানানো হোক। এবং এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হোক। কিন্তু এই হামলার ঘটনার পর পরই আওয়ামী লীগ নেতাদের এক একজনের এক এক রকম কথা আমাদের সংশয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একেবারে শুরুতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে বসলেন যে, এই হামলার পেছনে বিএনপি’র ইন্ধন রয়েছে। আজব কথা! তদন্ত হয়নি, তদন্ত রিপোর্টও প্রকাশিত হয়নি। আগে থেকে ওবায়দুল কাদের কি করে জানলেন যে, ঘটনার পেছনে বিএনপি’র ইন্ধন রয়েছে। সেও এক অপার রহস্য। জাফর ইকবালের ওপর হামলা হতে পারে এ কথা ভেবেই সরকার তার নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক ৪ জন পুলিশ নিয়োগ করেছিলেন।

কিন্তু সে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে কতোটুকু ঠুনকো তা আমরা দেখতে পেলাম তার পেছনে দাঁড়ানো পুলিশের তিন সদস্যের কর্মকাণ্ড থেকে। তারা ছিলেন জাফর ইকবাল থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আর ঘাতক দাঁড়িয়েছিল একেবারে জাফর ইকবালের ঠিক পেছনে। এটা কি করে সম্ভব হলো তা আমাদের বোধগম্য নয়। যে তিন জন পুলিশ মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের একজন চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সম্ভবত তিনিও ওই রোবোফাইট অনুষ্ঠান দেখায় মনোযোগী ছিলেন। বাকি দুইজন হয় মোবাইলে গেম খেলছিলেন, নয়তো ফেস বুক খেলছিলেন। মাথা নিচু করে সেদিকেই তারা মনোযোগী ছিলেন। এতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, দায়িত্ব পালনে তারা কতটা অবহেলা করেছিলেন। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কি করছিলেন ওই পুলিশ সদস্যরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে বসলেন, জাফর ইকবালের নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি ছিল না। যদি ঘাটতিই না থাকে তাহলে পুলিশ কেন দূরে মোবাইলে খেলছে। আর ঘাতক কেমন করে দাঁড়িয়ে আছে জাফর ইকবালের ঠিক পেছনে। একে যদি আমরা নিরাপত্তার ঘাটতিহীনতা না বলি তাহলে কাকে যে নিরাপত্তার ঘাটতি বলবো তাও আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।

শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও গত কিছুদিন যাবৎ ছাত্রলীগের তা-ব পাহাড় ছুঁয়েছে। সংঘাত, সংঘর্ষও সেখানে নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং-এর দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৫ ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। এরা প্রথম বর্ষের ছাত্রদের বেধড়ক মারধোর করে তাদের নগ্ন ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতে বাধ্য করে। ড. জাফর ইকবাল তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ জানান। গত শুক্রবার তিনি বলেন, ‘র্যাগিং-এর দায়ে তাদের যে শাস্তি দেয়া হয়েছে তা আসলে খুবই কম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার দরকার ছিল। এবং রাষ্ট্রীয় আইনে তাদের বিচার করা দরকার ছিল। তাদের অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় শাস্তি দেয়া হয়েছে। শাস্তি গ্রহণ করে ওদের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটা না করে তারা আন্দোলন শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি ছাত্রদের কষ্ট দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবিও করেছে। এটা খুবই লজ্জার।’ এই ঘটনার জন্য তিনি জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এটা সকলেই জানেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অনিষ্টের মূল ছাত্রলীগ। তারা ড. জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকেও হতে পারে। ফয়জুরের পরিচয় নিয়ে নানা ধরনের কথা বলা হচ্ছে। আমরা জেনেছি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রই না। তাই যদি না হবে তাহলে সে কেমন করে ঠিক জাফর ইকবালের পেছনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকল এবং সুযোগ বুঝে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আশপাশে যারা দাঁড়িয়েছিল, ধারণা করি, তারা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। কিন্তু কেউই ফয়জুরকে চ্যালেঞ্জ করেনি। যারা পুলিশকে সরিয়ে দিয়ে ওখানে দাঁড়িয়েছিল, তারা নিশ্চয়ই ছাত্রলীগ। একথা আমি এজন্য বলছি যে, অন্য কেউ সেখান থেকে পুলিশকে সরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। ছাত্রলীগ ধমক দিয়েই সরিয়ে দিতে পারে। ধরা যাক, সেরকম ধমকই তারা দিয়েছিল। কিন্তু তারপর সত্যি সত্যি পুলিশ সরে গিয়ে মোবাইলে খেলতে শুরু করে দিল?

এখন ফয়জুর সম্পর্কে অনেক কথা বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে সে আহলে হাদীস জামায়াতের অনুসারী ছিল। সে বাজারে লুঙ্গি-গামছা বিক্রি করতো। একা থাকতো, খুব বেশি মিশতো না। এসব কথা আমরা সকল ক্ষেত্রে শুনি। ধরা যাক সে আহলে হাদীস, তাতে কি যায় আসে। এখানে সুন্নিরা তো শিয়াদেরকে মুসলমান বলেই মানেন না। কিন্তু সমাজে নিশ্চয় তাদেরও থাকবার অধিকার আছে। তাদের নিজস্ব ধর্মমত পালনের অধিকার আছে। সে আহলে হাদীস অতএব সে সন্ত্রাসী- এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। শিয়া-সুন্নিরা খুব ভালো, আহলে হাদীস খুব খারাপ এটাও কোনো যুক্তি নয়। সমাজের দাবি, যার যার ধর্ম বিশ্বাস সে নির্বিঘেœ পালন করুক। এতোদিন ধরে সরকারের লোকেরা অবিরাম বলে আসছিল যে, মাদ্রাসাগুলো জঙ্গি তৈরির কারখানা নয়। এর আগে অবশ্য তারা অবিরাম নিনাদ করেছে যে, মাদ্রাসাগুলোয় হচ্ছে জঙ্গি তৈরির কারখানা। কেউ কেউ এমন দাবিও করেছেন যে, দেশের মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেয়া হোক। কিন্তু তারপর সরকার মত পরিবর্তন করেছেন। এখন আর তাদেরকে জঙ্গি বলা হয় না। ফয়জুর মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাস করেছে। তারপর আর পড়াশোনাই করে নাই। তার বাবা এলাকায় মাদ্রাসা শিক্ষক এবং ধর্মপ্রাণ ও সজ্জন ব্যক্তি বলে পরিচিত। ফয়জুরের এই ঘটনার পর তার বাবা-মা থানায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। এখনো কথার তুবড়ি চলছে। র্যাব’র তরফ থেকে বলা হয়েছে, ফয়জুর কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। কি সেই জঙ্গি সংগঠন সে বিষয়ে তারা স্পষ্ট করতে পারেন নাই। তার পর শুরু হয়েছে পরস্পরের প্রতি নানা বিষোদগার। এখন ফয়জুরের চাইতেও বড় ইস্যু হয়ে গেছে এর রাজনৈতিক প্রভাব।

গত তিন-চার দিন ধরে আওয়ামী লীগাররা এই হামলার ঘটনার সঙ্গে বিএনপি জড়িত বলে শোরগোল চালিয়ে আসছে। কিন্তু জামায়াত কেন বাদ যাবে। আর সে কথা স্মরণ করে অশীতিপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত বলেছেন ‘আই অ্যাম শিওর, এই ঘটনার জন্য জামায়াত দায়ী’। অর্থাৎ ফয়জুর জামায়াতের সদস্য। কিন্তু জামায়াত শিয়া বা আহলে হাদীসের পৃষ্ঠপোষক নয়। তাহলে চট করেই কেন তাদের দৃশ্যপটে টেনে আনলেন এই বয়োবৃদ্ধ ‘স্টুপিড রাবিশ’-এর জন্য খ্যাত অর্থমন্ত্রী নিজে। অর্থাৎ সরকার এই অপরাধের ঘটনাকে রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে এখান থেকে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে পুলিশের আইজিপি বলেছেন, ফয়জুর কারো মদদে নয়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এ কাজ করেছে। তাহলে কোনটা সত্য? ওবায়দুল কাদেরের কথা, র্যাব’র কথা, মুহিতের কথা নাকি আইজিপি’র কথা? এটা ধুলায় অন্ধকার। বিএনপি’র তরফ থেকে বলা হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুকে আড়াল করার জন্য ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কোনো পক্ষের কাছেই কোনো প্রমাণ নেই। ফয়জুর বলেছে ড. জাফর ইকবাল ভূতের বাচ্চা সোলায়মান নামে একটি বই লিখে সোলায়মান নবীর অবমাননা করেছেন। ফলে সে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জাফর ইকবালকে আঘাত করেছে।
বিএনপি’র তবু একটি যুক্তি আছে। কারণ আমরা সব সময় দেখি, দেশে যখন কোনো ইস্যুতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন সরকার ক্রিকেট খেলা লাগিয়ে দেয়, কিংবা সিঙ্গাপুর থেকে সোফিয়াকে এনে পুতুল নাচের আসর বসায়। এভাবে জনগণের দৃষ্টি সব সময় ভিন্ন খাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। সুতরাং এটা যৌক্তিক যে, এ যাত্রায়ও সরকার তেমন কিছু করে থাকতে পারে। সেটাই বিএনপি’র যুক্তি। কিন্তু আমরা এসব যুক্তির কাছে যেত চাই না। জাফর ইকবালের ওপর হামলার মতো ঘটনা নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, আমরা তাও সমর্থন করি না। ইস্যুটা রাজনীতিক নয়, ইস্যুটা অপরাধমূলক। এখানে পুলিশ কেন দূরে গিয়ে মোবাইলে খেলছে, কেমন করে ঘাতক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও ঠিক জাফর ইকবালের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে পারল এবং তাকে ছুরিকাঘাত করতে পারল এটা খুঁজে বের করাই সবচেয়ে জরুরি। কারণ একটার পর একটা এ ধরনের ঘটনা ঘটবে, আর তা নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি চলবে এটা কারো কাছে কাম্য নয়। অপরাধ, অপরাধই। সুতরাং অপরাধের মূল অনুসন্ধান করাই আমাদের প্রধান কর্তব্য।

http://www.dailysangram.com/post/321587