৬ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৯

নগরে খোঁড়াখুঁড়ি

যানজটে জনদুর্ভোগ বাড়লেও দেখার কেউ নেই : শত শত কোটি টাকার কাজে নেই কোনো নজরদারি

রাজধানীজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। দুই সিটি কর্পোরেশনসহ ঢাকা ওয়াসা, বিটিসিএল, তিতাস, ডেসা, ডেসকো, রাজউকসহ ২৬টি সেবাদানকারী সংস্থার সংস্কার আর উন্নয়নের কবলে ঢাকা এখন খোঁড়াখুঁড়ির নগরী। জনদুর্ভোগ এড়াতে শর্ত দিয়ে কাজ শুরু হলেও পরে আর তা মানা হয় না। দিনের পর দিন কাজ চলছে তো চলছেই। এতে করে যানজটসহ নানা দুর্ভোগে নাকাল নগরবাসী। শুধু তাই নয়, রাস্তাসহ ড্রেনেজ উন্নয়নের শত শত কোটি টাকার কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কি না তা দেখারও যেন কেউ নেই। ঠিকাদাররা তাদের খেয়াল খুশি মতো জোড়াতালিমার্কা কাজ করে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নগর বিশেষজ্ঞ এবং ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর মো: নজরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, উন্নয়নের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজন আছে। তবে তা অবশ্যই সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সমন্বয়ের মাধ্যমে দক্ষতার সাথে করতে হবে। তিনি বলেন, খোঁড়াখুঁড়ির কাজটা স্বল্পতম সময়ে করা উচিত। এই ধরণের কাজে একটু যতœবান এবং দায়িত্বশীল হলেই জনদুর্ভোগ অনেকটাই কমানো যায়। প্রফেসর মো: নজরুল ইসলাম বলেন, ধানমন্ডির ২৭ নং সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির মাধ্যমে পাইপ বসানোর কাজ চলছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানকার কাজে দক্ষতা ও যতœশীলতার অভাব রয়েছে। জনগণ বা পথচারি কারো ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অনুভূতি নেই। বরং দায়িত্বপ্রাপ্তরা জনদুর্ভোগের ব্যাপারে অকেটাই উদাসীন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, খোঁড়াখুঁড়ির কারনে সাময়িক অসুবিধা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা চেষ্টা করছি যাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করা যায়। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী জুনের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।
সরকার প্রতিবছর শত শত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে থাকে। কিন্তু এ উন্নয়ন কাজ যথা সময়ে বা যথা নিয়মে না হলে তা কল্যাণের পরিবর্তে বিষ ফোঁড়ায় পরিণত হয়। এমনি অনেক বিষফোঁড়া ভর করেছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের ঘাড়ে। মাসের পর মাস রাস্তা সংস্কার ও ড্রেনেজের কাজে খোঁড়াখুঁড়িতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। একদিকে খোঁড়াখুঁড়ির কারনে রাস্তা বন্ধ। যানবাহন চলতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজটের। আবার খোঁড়াখুঁড়ির জন্য অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
রাজধানীর মতিঝিলে ফুটপাত খুঁড়ে ড্রেন নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে এক মাসের অধিক সময় হলো। ব্যস্ত মতিঝিল এলাকার প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাজের গতি এতোটাই শ্লথ যে কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে তোয়াক্কাই করছে না। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনের এক ব্যবসায়ী বলেন, ফুটপাত ভেঙ্গে ড্রেন বানানোর কাজ চলছে। এতে করে প্রতিটি ভবনের সামনের অংশে বিশাল গর্ত করা হয়েছে কয়েক দিন ধরে। যেখানে ২৫জন শ্রমিক লাগে সেখানে মাত্র ৫জন দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এতে করে তিন দিনে যে কাজ শেষ হওয়ার কথা তা ১০ দিনেও শেষ হচ্ছে না। এতে করে আমাদের ব্যবসার চরম ক্ষতি হচ্ছে। আরকে মিশন রোডের এক ব্যবসায়ী বলেন, কজে শুরু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা কবে শেষ হবে কেউ জানে না। অথচ একদিন সময় মানেই আমাদের লাখ লাখ টাকা গচ্চা। খোঁড়াখুঁড়ির কারনে আরকে মিশন রোডের একটা মার্কেট পুরোই বন্ধ রাখতে হয়েছে। এমনিভাবে মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মোহাম্মদপুর, আদাবর, গাবতলী, ধানমন্ডি, পল্লবী, কাফরুল, বনানী, গুলশান, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, খিলগাঁও, বাসাবো, মালিবাগ, মৌচাক, ফকিরেরপুল, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, পুরানা পল্টন, আজিমপুর, নিউমার্কেট, নিউ পল্টন, লালবাগ, হাজারীবাগ, জিগাতলা, রায়েরবাজারসহ গোটা রাজধানীতে রাস্তা সংস্কার ও ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। কোনো কোনো এলাকায় এসব কাজের জন্য রাস্তা বন্ধ রাখা হয়েছে। ‘উন্নয়ন কাজ চলিতেছে, রাস্তা বন্ধ। বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করুন’- এরকম একটা সাইনবোর্ড লাগিয়েই দায় সেরেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করতে গিয়ে সহসাই সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজটের। তাতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছে নগরবাসী।
বাসাবো বিশ্বরোড থেকে নন্দীপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন কাজ চলছে গত কয়েক মাস ধরে। একই সঙ্গে মূল সড়কের দু’পাশের সব ছোট সড়কেরও উন্নয়ন করা হচ্ছে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের অধীনে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হয়েছে সুয়ারেজের লাইন মেরামতের কাজ। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত তিনমাস আগে সড়ক উন্নয়নের এই কাজ শুরু হয়েছে। যা চলতি মার্চ মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। তবে এলাকাবাসির দাবি, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে রাস্তার খোঁড়াখুড়ি। একসঙ্গে মূল সড়কের খোঁড়াখুড়ি আর এর সঙ্গে ছোট সড়কের উন্নয়ন কাজ চলায় জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, বাসাবোর মানুষ গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উন্নয়ন কাজের কারণে জিম্মি হয়ে পড়েছে। চার পাশের রাস্তা খোঁড়াখুড়ি চলছে। কোন দিক দিয়ে বের হওয়ার উপায় নেই। তার উপর কাজও চলছে ধির গতিতে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কোথাও সড়কে সংষ্কারের খোয়া-বালি আবার কোথাও সুয়ারেজের বড় বড় পাইপ। এতে মূল সড়কের মাত্র ২-৩ ফুট জায়গা রয়েছে হাঁটার জন্য। বাকিটা উন্নয়ন সামগ্রীর দখলে। এতে করে এসব সড়কে হেঁটে চলাচল করতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত যাত্রাবাড়ীর দনিয় এলাকায় ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে গত দেড় বছর ধরে। যাত্রাবাড়ী থেকে দনিয়া পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণের কাজের জন্য গত দেড় বছর ধরে লাখ লাখ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দনিয়া পপি হাসপাতাল থেকে গোয়ালবাড়ী মোড় পর্যন্ত সামান্য দূরত্বে ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে গত কোরবানীর ঈদের আগে। এখনও পর্যন্ত সেই কাজ চলছেই। মাত্রও জ্জ জন শ্রমিক দিয়ে ড্রেন খননের কাজ করানো হচ্ছে। আবার ড্রেনের পঁচা-দুর্গন্ধযুক্ত মাটি ফেলা হচ্ছে রাস্তার উপর। এতে করে রাস্তা ভরাট হয়ে যানবাহন এবং পথচারী চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা দনিয়া এলাকায় ড্রেন নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। সীমানা অনুযায়ী ড্রেন না করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার টাকার বিনিময়ে সমঝোতা করে ড্রেন ঘুরিয়ে নিচ্ছেন বলে কয়েকজন অভিযোগ করেন। শুধু তাই নয়, ড্রেনের কাজে যতোটুকু ঢালাই দেয়া হয়েছে সেখানেও সঠিকভাবে পাথর, বালু, সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি। এতে করে ঢালাইয়ের কাজ টিকসই হচ্ছে না। হামিদ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এখানে মিস্ত্রিরা তাদের খেয়ালখুশি মতো কাজ করছে। কাজের তদারকি করার মতো কাউকে দেখা যায় না। শত শত কোটি টাকার কাজ হচ্ছে অথচ ইঞ্জিনিয়াররা একবার তা দেখতে আসেন না। এ যেন এক মগের মুল্লুক।
জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে সব মিলিয়ে রাস্তা ২৩৫০ কিলোমিটার। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই এসব রাস্তা সংস্কার ও ড্রেনেজের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই। ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৭টি প্রধান সড়ক এবং আড়াইশ’ অভ্যন্তরীণ ও গলি সড়কে চলছে সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি। আর সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন চলছে ২৬৯টি রাস্তাায়। অপরদিকে, দক্ষিণ সিটিতে ১ হাজার কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ১৫টি প্রধান সড়কে বহুদিন ধরেই সংস্কারের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছ ড্রেনেজের কাজ। ভুক্তভোগিদের অভিযোগ, খোঁড়াখুঁড়ির পর কোথাও কোথাও সড়ক মেরামতে পেরিয়ে যায় মাসের পর মাস। তবুও টনক নড়ে না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এতে করে যানজটের ধকলের সাথে বাড়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-১ ও দুই নম্বর গোল চত্বরেও চলছে ড্রেনেজ নির্মাণের কাজ । এর সাথে আছে বিভিন্ন সেবা সংস্থার পক্ষ থেকে চলছে রাস্তা কাটাকাটি। কখন কোন রাস্তা বন্ধ হয় কেউ জানে না। আগে থেকে না জানার কারনে বন্ধ রাস্তায় আটকে গিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীজুড়েই চলছে খোঁড়াখুঁড়ির উৎসব। উন্নয়ন ভোগান্তির মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্ষা মৌসুমের আগেই কাজ শেষ করার কথা।
তবে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোটা রাজধানীই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। সেবা সংস্থাগুলো পরিকল্পিতভাবে কাজ করেনি। তাই প্রতি বছর রাস্তা কাটাকাটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। এতে দিন দিন নাগরিক দুর্ভোগ বাড়ছেই। যতক্ষণ না পর্যন্ত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এসব কাজ করা হবে, ততোক্ষণ এই দুর্ভোগ কমবে না।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/120231/