ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা রাস্তায় জমে থাকা বর্জ্য অপসারণ করে তা সংস্থার খোলা ট্রাকে পরিবহন করে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। ছবিটি মিরপুরের দারুস সালাম এলাকা থেকে ফ্রেমবন্দী করেছেন আমাদের চিত্র সাংবাদিক আজিজ ফারুকী
৫ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৭:৫৪

দিনের বেলায়ও ঢাকনাবিহীন গাড়িতে বর্জ্য অপসারণ ॥ ভোগান্তিতে নগরবাসী

রাজধানী ঢাকার সব ধরনের বর্জ্য রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে অপসারণের আদেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। পাশাপাশি ঢাকনা ছাড়া ট্রাক বা ভ্যান দিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন বন্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলা হয় ওই আদেশে। গত বছরের ১৬ অক্টোবর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে দেয়া ওই আদেশটি পালন করছে না কোন সিটি কর্পোরেশন। হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় দিনের বেলা বর্জ্য অপসারণের কাজ চলছে ঢাকনাবিহীন পরিবহনেই। ফলে নানা রকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে রাজধানীবাসী।
হাইকোর্ট ওই আদেশে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকনাবিশিষ্ট যানবাহন দিয়ে নির্ধারিত সময়ে বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহনের জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা জানিয়ে ৪৫ দিনের মধ্যে আদালতকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে রুলসহ এ আদেশ দেন। জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন রিট আবেদনটি করেন।

জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষামতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য জমা হচ্ছে প্রায় সাত হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে গৃহস্থালি ও দোকান থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টন ময়লা তৈরি হয়।
প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস রাজধানী ঢাকা শহরে। বাসাবাড়ির ময়লাসহ রাজধানীতে প্রতিদিন জমা হয় প্রায় সাত হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য। প্রতিদিন জমা হওয়া এসব বর্জ্য অপসারণে দুই সিটিতে (ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ) নেই পর্যাপ্ত জনবল। যে কারণে বর্জ্য অপসারণে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে দুই সিটি কর্পোরেশন।
‘কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে’- উল্লেখ করে দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে বাসাবাড়ির ময়লার পরিমাণ অনেক বেশি। এ কারণে সময় মতো সবকিছু পরিচ্ছন্ন করতে কিছুটা সময় বেশি লাগে। পরিচ্ছন্নকর্মীরা এসব বর্জ্য অপসারণে রাত থেকেই কাজে নামেন। সকালের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল ও ঢাকনাযুক্ত গাড়ি না থাকায় সঠিক সময়ের মধ্যে সব বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব হয় না।’

মতিঝিল, খিলগাও, বাসাবো, মমুগদা, মানিকনগর, গুলশান, ফার্মগেট, মিরপুর, কলাবাগান, তেজগাঁও, মগবাজার, পল্টন, পান্থপথ, পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিনে-দুপুরে ঢাকনাবিহীন ময়লবাহী ট্রাক বা ভ্যানে করে চলছে ময়লা পরিবহনের কাজ। কিন্তু নগরবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে এসব ময়লা দিনের বেলা অপসারণ করা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি ঢাকনাযুক্ত গাড়িতে বর্জ্য অপসারণের নির্দেশ ছিল।
সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিনের বেলাতেই খোলামেলাভাবে বর্জ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এর পাশ দিয়ে যাদের চলাচল, তাদেরকে দেখা গেছে দুর্গন্ধে নাক টিপে আছেন।
শুক্রবার সকাল আটটা। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়কের পুরান ঢাকার নিমতলী ফটক। বর্জ্যবোঝাই একটি খোলা ট্রাক উঠছে উড়ালসড়কটিতে। ট্রাকটিতে ব্যবহার করা হয়নি কোনো ত্রিপল। এ কারণে ট্রাক থেকে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। বাতাসে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ। অথচ, খোলা ট্রাকে বর্জ্য অপসারণে ত্রিপল ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
এ ছাড়াও লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, ধানমন্ডি, বংশাল, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, বিজয় সরণি, বাড্ডা, তেজগাঁও রেলগেট, মোহাম্মদপুর, গাবতলী এলাকায় অন্তত ১৫টি খোলা ট্রাকে এভাবে বর্জ্য বহন করতে দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটিতে ত্রিপল ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তাও সেগুলো ছিল ছেঁড়া।
জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ১৪০টি খোলা ট্রাকে বর্জ্য পরিবহন করে। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) খোলা ট্রাক আছে ২৩৮টি।
রাজপথে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে ময়লাবাহী ট্রাকগুলো যায় দুটি গন্তব্যে। ঢাকা দক্ষিণের ময়লা নেয়া হয় মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে এবং উত্তরের ময়লা ফেলা হয় আমিনবাজারের ল্যান্ডফিলে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, আগে ভোর চারটার আগে বর্জ্য অপসারণ ও রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তা করা হচ্ছে না। সকাল আটটার দিকেও রাস্তা ঝাড়ু দেয়া হচ্ছে। খোলা ট্রাকে করে দিনভর বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থী ও অফিসগামী লোকজনকে সমস্যায় পড়তে হয়। তিনি বলেন, খোলা ট্রাক থেকে বর্জ্য ও ময়লা পানি সড়কে পড়ার কারণে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব বর্জ্যরে কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে। তাই খোলা ট্রাকে বর্জ্য অপসারণ বন্ধ করতে হবে।
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, ডিএসসিসি এলাকায় দিনে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টন বর্জ্য জমা হয়। খোলা ট্রাকের পাশাপাশি ১২০টি কনটেইনারবাহী ট্রাক দিয়ে এসব বর্জ্য পরিবহন করা হয়। এসব ট্রাক দিয়ে বর্জ্য অপসারণ করতে দৈনিক ৬৫০ থেকে ৭০০টি ট্রিপ লাগে। অন্যদিকে ডিএনসিসি এলাকায়ও প্রায় একই পরিমাণ বর্জ্য জমা হয়। তাদের কনটেইনারবাহী ট্রাক আছে প্রায় ৬০টি।
ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা বলেন, খোলা ট্রাকে বহন করা বর্জ্য ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখতে ট্রাকচালক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু অনেক সময় চালকেরা তা করেন না। এমন গাফিলতির কারণে অনেক চালককে শাস্তি দেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, বর্জ্যবাহী খোলা ট্রাক থেকে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আর ট্রাকের আশপাশে থাকা যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরা নাক-মুখ চেপে চলছে।
মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন। একটি কোম্পানির বিপণন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরির সুবাদে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে হয় তাকে। রাজধানীর বর্জ্য অপসারণের বিষয়ে তিনি বলেন, চাকরির কারণে সারাদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে হয়। প্রতিদিন বাসা থেকে সকালে বের হতে হয়। বের হয়েই চোখে পড়ে ময়লা অপসারণের দৃশ্য। যেখানে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া পাওয়ার কথা সেখানে পথচারীদের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে নাকে রুমাল চেপে চলাচল করতে হয়। তিনি আরও বলেন, চরম বিরক্তি নিয়ে পথচারীদের চলাচল করতে হয়। সিটি কর্পোরেশনের উচিত নাগরিক ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে রাতেই এসব বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা করা। ‘ঢাকনাযুক্ত গাড়িতে বা ভ্যানে এসব ময়লা অপসারণের ব্যবস্থা করা গেলে তীব্র দুর্গন্ধের দুর্ভোগ থেকে রাজধানীবাসী কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পেতো’ বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর শফিকুল আলম বলেন, বর্জ্য অপসারণের কাজ রাত থেকে শুরু হয়। ভোর ৬টার মধ্যে ময়লা অপসারণের কাজ শেষ হয়। কাভার্ডভ্যানেই ময়লা পরিবহন হয়। এ ছাড়া খোলা ট্রাকগুলোতে ত্রিপল লাগানো থাকে। ‘হয়তো ইমার্জেন্সি প্রয়োজনে দিনের বেলায় খোলা গাড়িতে ময়লা সংগ্রহ ও অপসারণের ব্যবস্থা করা হয়’ বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ রাতের মধ্যেই বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। পর্যাপ্ত জনবল ও গাড়ি সংকটের কারণে মাঝে মধ্যে কোনো কোনো এলাকাতে বাধ্য হয়ে দিনের বেলায় বর্জ্য অপসারণ করা হয়।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির অতিরিক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, খোলা ট্রাকে বর্জ্য অপসারণের সময় ত্রিপল ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। তাই প্রতিটি ট্রাকেই ত্রিপল দেয়া আছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রিপল ব্যবহার না করলে চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

http://www.dailysangram.com/post/321307