৫ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৭:৫২

আমদানির আড়ালে আসলে কি হচ্ছে?

আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার বাড়লেও অনেকটা নির্বিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। লাগামহীন আমদানিতে চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল এবার ১৫৬ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটছে, কিন্তু দৃশ্যমান বিনিয়োগ নেই। আমদানির নামে টাকা পাচার হচ্ছে। অর্থনীতিতে এ অশুভ ছায়া দেখে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আমদানির আড়ালে আসলে কি হচ্ছে? এতে করে অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে।

জানা গেছে, দুই দফা বন্যায় খাদ্য সঙ্কট এড়াতে সরকার শুল্ক কমিয়ে আনার পর সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়েই চাল আমদানি বাড়ছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধে চাল আমদানির জন্য ৯৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। এই অংক গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে ৫৩১৬ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে চাল আমদানিতে ব্যাংকগুলোয় ৫৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পুরোটা সময় চাল আমদানিতে ২৭ কোটি ৪১ লাখ ডলার এলসি খোলা হয়।
অর্থাৎ গত বছর ১২ মাসে চাল আমদানিতে যে ব্যয় হয়েছে, চলতি অর্থবছরের শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই তার দ্বিগুণ ব্যয় হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) চাল আমদানিতে ৯৩ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮৫ গুণ বেশি। গত অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে চাল আমদানিতে মাত্র ৫০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়। আলোচ্য সময়ে চাল আমদানিতে খোলা ৩৩ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। গত বছরে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৩৫ লাখ ডলারের এলসি। নিষ্পত্তির হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৯১ গুণ।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলায় ১ হাজার ৪৭০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময় এই ব্যয় ছিল ১ হাজার ৭৭ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৩৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ১ হাজার ১৮২ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে।
গত অর্থবছরে নিষ্পত্তি হয় ১ হাজার ১৬১ কোটি ডলারের এলসি। আলোচ্য সময়ে শিল্পের মূলধন যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলার হার অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১৩২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে এলসি খোলায় ব্যয় হয় ১০৩ কোটি ডলার। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় ৩৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১১১ কোটি ডলার।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে সুতা (ইয়ার্ন) আমদানির এলসি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ওষুধের কাঁচামালে বেড়েছে ৫১ শতাংশ, মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) ৬৯ শতাংশ এবং জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৯ শতাংশ।

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে তিন হাজার ৩৩৬ কোটি (৩৩ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন) ডলার ছিল। সোম অথবা মঙ্গলবার আকুর আমদানি বিল পরিশোধের পর তা ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আকুর সদস্যভুক্ত নয়টি দেশ থেকে যে সব পণ্য আমদানি করা হয় তার বিল একসঙ্গে আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করে বাংলাদেশ। দুই মাস পর পর এই বিল শোধ করতে হয়।

আমদানি বাড়ায় এবার জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদে আকুর বিল হয়েছে ১৫৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর আগে কখনই বাংলাদেশের আমদানি বিল এত বেশি হয়নি।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে ১১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদে শোধ করা হয় ১১৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের বিল।
আমদানি বিল এই হারে বাড়তে থাকলে রিজার্ভ চাপের মুখে পড়বে মন্তব্য করে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রতি মাসেই আমদানি ও এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আমদানি ব্যয় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। আমি হিসাব করে দেখেছি, চলতি অর্থ বছর শেষে আমদানি ব্যয় ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

আহসান মনসুর বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির যে উল্লম্ফন, সেটা মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ অন্যান্য বড় প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির কারণে। এছাড়া চাল, জ্বালানি তেল, ক্যাপিটাল মেশিনারি এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও বেড়ছে।
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি হয়েছে ২৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এই সময়ে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানি বেড়েছে ২১২ শতাংশ। ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলছেন, প্রবৃদ্ধি উর্ধ্বমুখী থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, আমদানি বাড়ছে।

বর্তমানে যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। সামনের দিনগুলোতে সার্বিক রিজার্ভ পরিস্থিতি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অনুকূল থাকবে বলেই আশা করছি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ৩৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়।
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যে সব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি অনেক বেশি হারে বেড়েছে। যা দেশের বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু একই সময়ে কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ। যা বিনিয়োগ কমার ইঙ্গিত। আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে সরকারকে। এর ফলে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে খাদ্য আমদানিও।
মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়লেও সে অনুপাতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি না বাড়ায় এর আড়ালে অর্থ পাচারের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, আমদানি বাড়লেও এর বিপরীতে পণ্য আসছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান তারা। ওভার ইনভয়েসিং হলো, কম দামের পণ্য বেশি দাম দেখিয়ে টাকা পাচার করা। যে পরিমাণ আমদানি হচ্ছে ওই পরিমাণ পণ্য দেশে আসছে কিনা এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। ফলে প্রকৃত আমদানি বাড়ছে না বলেই তাদেরও ধারণা।
যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক গর্বনর ফজলে কবির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বলেছেন, সরকার ঘোষিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের ধারা বজায় রাখতে কাজ করছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। সেজন্য বড় ঋণের পরিবর্তে ছোট ছোট খাতে বেশি ঋণ দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কোনো রকম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় যাতে উন্নয়ন ব্যাহত না করে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।

এদিকে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্প-কারখানা বসানোর পরও বিভিন্ন সমস্যার কারণে উৎপাদনে যেতে পারছেন না তারা। যে কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতির তুলনায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কম। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, অসংখ্য কারখানায় নতুন যন্ত্রপাতিসহ বিনিয়োগ হয়েছে, উৎপাদনের জন্য তারা প্রস্তুত, কিন্তু গ্যাস সংযোগের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না।
নামে বেনামে আমদানি করে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। এমন অভিযোগে শুল্ক গোয়েন্দা চট্টগ্রামে কন্টিনার আটক করলেও মূল হোতারা এখনও ধরা ছোয়ার বাহিরে রয়ে গেছে। নারায়নগঞ্জের এক রিক্সা চালকের নামে কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি করলেও সে জানেনা কে বা কারা তার নামে পণ্য আমদানি করেছে বা কি পণ্য আমদানি করেছে।

তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড আর ঠিকানা ব্যবহার করে এসব পণ্যের নামে কোট কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। একই ভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি নামেও মোটা অংকের টাকা পাচার হচ্ছে। পাচারের তথ্য ফাস হলেও পাচারকারিরা থাকেন নিরাপদে। আর এসব কারনেই পাচার বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে। আর আমাদের অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমানও বেড়েছে। যা অর্থনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে।

 

http://www.dailysangram.com/post/321309