৪ মার্চ ২০১৮, রবিবার, ১১:১০

অস্থির শেয়ার বাজার

বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়ে কোনো সরকারই রাজনীতি বা অর্থনীতির ক্ষেত্রে অস্থিরতা দেখতে চায় না। গত তিন মাস ধরে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা চলছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চমহলে বেশ উদ্বেগও রয়েছে। শেয়ারবাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, আইসিবির শীর্ষ নেতৃত্বকে ডেকে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। তার নির্দেশে আইসিবি নতুন করে বিনিয়োগে এসেছে। এর কিছুটা ইতিবাচক প্রভাবও দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে। দরপতনের ধারা বন্ধ হয়েছে। সর্বশেষ তিন দিন শেয়ারদর বাড়ায় সূচক বেড়েছে। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস গত বৃহস্পতিবার অধিকাংশ শেয়ারের দর বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিএসইএক্স সূচক ৬৬ পয়েন্ট বা প্রায় সোয়া ১ শতাংশ বেড়েছে।

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করেন, ব্যাংকিং খাতে চলমান সংকটই সাম্প্রতিক দরপতন ও অস্থিরতার বড় কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই এ সংকট তৈরি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ এনে বিএসইসির কর্মকর্তারা বলছেন, শেয়ারবাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে- এটা জেনেও বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে যা আগে থেকে বিএসইসিকে অবহিত করা হচ্ছে না। যদিও এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনাটি যে বাংলাদেশ ব্যাংক মানছে না তা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ও অবহিত।

গত বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এবং গত মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাজারে দরপতনের কারণ নিয়ে আলোচনা হয়। এসব বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ইউনূসুর রহমান, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির চেয়ারম্যান ড. মুজিব উদ্দিন আহমেদসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, বিএসইসির কর্মকর্তারা বাজারে অস্থিরতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান এবং ব্যাংকিং খাতের সংকটাবস্থাকেই দায়ী করেন। তারা বলেন, দরপতনের অন্যতম কারণ ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) ইস্যু। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের সীমা অতিরিক্ত আমানত ফিরিয়ে দিতে বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবিকে নির্দেশ দেওয়াও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করেন, বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে এ পরিস্থিতি হতো না।

বিএসইসির চেয়ারম্যান সমকালকে বলেন, ওই সভায় শেয়ারবাজারের চলমান সংকটাবস্থার কারণ অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। জানতে চাইলে আইসিবির চেয়ারম্যান বলেন, অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। যেসব সমস্যা ছিল তার সবটাই সমাধান দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আশা করি, ভবিষ্যতে এ নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিএসইসির সঙ্গে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেন, ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা, মুদ্রানীতি, মূল্যস্ম্ফীতিসহ যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনগতভাবে স্বাধীন সংস্থা। আইনি ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব নীতি ও পদক্ষেপ নেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, প্রতিটি সংস্থাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণে স্বাধীন। তিনি আরও বলেন, প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রই মুদ্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। এজন্য মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে এর কোনোটিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, কখনও কোনো খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শুধু বাংলাদেশে এমন প্রভাব পড়ে, তা নয়। বিশ্বের সব দেশেই এমনটা হয়।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ পলিসি রেট (বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত ঋণের সুদহার) বাড়ানোর ঘোষণা দিলে সে দেশের শেয়ারবাজারসহ বিশ্বের বড় সব শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়- এ উদাহরণ টেনে ডেপুটি গভর্নর আরও বলেন, এ নিয়ে ওই দেশে হৈচৈ হয়েছে বলে শোনেননি। শুধু শেয়ারবাজারের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বাকি অর্থনীতির কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির সঙ্গে আলোচনা করে ফেডারেল রিজার্ভ কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা কেউ ভাবেও না বলে তিনি জানান।

তবে বিএসইসির কর্মকর্তারা বলেন, শেয়ারবাজার একটু ঊর্ধ্বমুখী হলে ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগকে লাগাম টানার নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সব পদক্ষেপ নেয়, যা পুরো শেয়ারবাজারে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পৃথিবীর কোনো দেশে এমনটা হয় না। এটা নিয়েই আপত্তি বিএসইসির। গত নভেম্বর থেকে শেয়ারবাজারে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তার মূল কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকেরই একটি পদক্ষেপ। যাতে গত তিন মাসে দরপতনে প্রায় ৭৫ ভাগ শেয়ারের দাম কমেছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অনেকেই পুঁজি হারিয়েছেন।

বিএসইসি কর্মকর্তারা বলেন, অনেক বছর ধরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আইসিবির কাছে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের আড়াই হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে অতিরিক্ত আমানত হিসেবে উল্লেখ করে ডিসেম্বরের মধ্যে ফেরত দিতে আইসিবিকে নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশ পালন করতে হলে শেয়ার বিক্রি করতে হবে বলে জানায় আইসিবি। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, এতে শেয়ারবাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা আমলে নেয়নি। শেষে আইসিবি বাধ্য হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করলে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ব্যাপক দরপতন শুরু হয়। এ সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে- আইসিবি ডিসেম্বরের মধ্যে দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করবে। এ গুজবে পুরো ডিসেম্বরজুড়ে দরপতন হয়। পরে এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণায়লের সিনিয়র সচিব ইউনূসুর রহমানের হস্তক্ষেপে অতিরিক্ত আমানত ফেরত দেওয়ার সময় বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেও এরই মধ্যে শেয়ারবাজারের যে ক্ষতি হওয়ার তা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এদিকে এডিআর ইস্যুটিও শেয়ারবাজারকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে জানিয়েছে বিএসইসির কর্মকর্তারা বলেন, ডিসেম্বরের দরপতন শেষ না হতেই জানুয়ারির শুরুতে এসে হঠাৎ করে ব্যাংকার্স সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক একবারে সাড়ে ৪ শতাংশ এডিআর কমানোর আগাম ঘোষণা দেয়, যা এর আগে কখনোই করেনি। এর পরই ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বেড়ে যায়। ব্যাংকে সুদহার বেড়ে যায়। ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ ছাড় কমে যায়। বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহে টান পড়ে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারে।

বিএসইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধসের পর অনাকাঙ্ক্ষিত অস্থিরতা এড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রতি একটি সার্কুলার জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলতে পারে এমন যে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বিএসইসিকে আগেই অভিহিত করতে হবে। প্রয়োজনে সংস্থাটির পরামর্শ নিতে হবে। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এই নির্দেশনাটি মানছে না।

শেয়ারবাজার ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা নিয়ে এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ ৫ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনূসুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। জানতে চাইলে ইউনূসুর রহমান সমকালকে বলেন, এ দুই সংস্থার কাজের ক্ষেত্র ভিন্ন। সিদ্ধান্তও ভিন্ন হবে। একের সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ অন্যের ক্ষেত্রে প্রভাবও ফেলতে পারে। তবে উভয় সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীতা আছে বলে মনে করি না। কোনো সংকট থাকলে তা পারস্পরিক আলোচনায় সমাধানের সুযোগ আছে। সরকারের পক্ষ থেকেও সে রকম নির্দেশনা দেওয়া আছে।

 

http://www.samakal.com/economics/article/1803191