নৌযোগাযোগ মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশ বিপন্ন
৪ মার্চ ২০১৮, রবিবার, ১১:০৯

তীব্র নাব্য সঙ্কট

দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী

হাজার নদীর বাংলাদেশে একের পর এক নদ-নদী এবং নৌপথের অস্তিত্ব সংকটে উপকূলীয় এলাকা ও দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সুলভ নৌযোগাযোগ এবং ইলিশসহ মৎস্য সম্পদও হুমকির মুখে। পানি বিশেষজ্ঞদের মতে এর ফলে লবনাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, পয়ঃপ্রনালীর সংকীর্ণতা, উপকূল অঞ্চলে মৌলিক গঠনতান্ত্রিক অচলবস্থাসহ প্রতিকূতা জোরদার হচ্ছে। নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। উজানের প্রবাহের বাঁধার কারনে ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে শত কিলোমিটারেরও বেশী উজানে লবনাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। যা প্রতিবছরই আরো ৫-১০কিলোমিটার পর্যন্ত এগুচ্ছে বলে নদী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১লাখ ৪৭হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের বাংলাদেশ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নামের বৃহৎ ৩টি নদীই উজান থেকে ভাটিতে এসে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এ ৩ নদীর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা থাকলেও তার অধিকাংশের অস্তিত্বই এখন বিলীনের পথে। সীমান্তের ওপার থেকে আসা ৫৭টি নদ-নদীর ৫৪টিই ভারত থেকে, অবশিষ্ট ৩টি মায়ানমার থেকে। ভারত থেকে আসা গঙ্গা আমাদের দেশে পদ্মা নামকরন হয়ে সারাদেশের পানির উৎসের বড় আঁধার হলেও ফারাক্কা বাঁধের কারনে এ নদীর সাথে দক্ষিণাঞ্চলের বেশীরভাগ নদ-নদীর প্রবাহ হ্রাস পেয়ে ধুধু বালিয়াড়ীতে পরিনত হয়েছে। তিস্তাসহ অন্যান্য নদীতেও বাঁধ দিয়ে ভারত পানি প্রত্যাহার করে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও মৎস সম্পদ সহ চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।

এক সময়ে প্রায় ১৩শরও বেশী নদীর অস্তিত্ব থাকলেও ডাচ হাউড্রোগ্রাফী জরিপ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন সময়ে জরিপ এবং সর্বশেষ সিইজিআইএস-এর জরিপে দেশে ৪০৫টি নদীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাশাপাশি একাধিক নদী গবেষনামূলক গ্রন্থে ১১০৭টি নদী উল্লেখ রয়েছে।
ডাচ জরিপের ভিত্তিতে ১৯৭৫ সালে বিআইডবিøউটিএ তার মাইলেজ টেবিল-এ দেশে ১৩ হাজার ৭৭০কিলোমিটার শ্রেণীবদ্ধ নৌপথ খুজে পায়। কিন্তু ১৯৮৭-৮৮ সালে অনুরূপ আরেক জরিপে তা ৬ হাজার কিলোমিটার হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে তা ৪হাজার ৬৬০কিলোমিটারের মত। কিন্তু বন্ধু প্রতিম(?) প্রতিবেশী দেশের বিবেকহীন কর্মকান্ডে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে মরুপ্রবনতা নদ-নদীবহুল দক্ষিণাঞ্চলেও কালো থাবা ফেলেছে। একের পর এক নদ-নদীর বুক ক্রমশ মরুভূমিতে পরিনত হচ্ছে। কোনমতে অস্তিত্বের জানান দেয়া নদ-নদীগুলোও ইতোমধ্যে তিন-চতুর্থাংশ ভড়াট হয়ে সর্বনিম্ন নাব্যতায় পৌছেছে। গত ৫০ বছরে দেশের ৫ শতাধিক ছোট-বড় নদ-নদী মানচিত্র থেকে মুছে গেছে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষনায় বলা হয়েছে। বর্তমানে যে ২৩০টি নদ-নদী তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে, তাও ভবিষ্যতে ভয়াবহ নাব্য সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞগন।

শুধু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বরিশাল নদী বন্দর থেকেই প্রতিবছর অন্তত ৩০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করছে। দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো নদী বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে প্রতি বছর ১ কোটিরও বেশী যাত্রী যাতায়াত ছাড়াও পণ্য পরিবহন হচ্ছে প্রায় ৫৫লাখ টন। কিন্তু প্রতি বছরই শুষ্ক মওশুমে ড্রেজিং করেও ছয়মাস না ঘুরতেই বৃহত্তম বরিশাল নদী বন্দরের নাব্যতা ১০ ফুটেরও নিচে হ্রাস পাচ্ছে। একই পরিস্থিতি পটুয়াখালী ও ভোলা নদী বন্দরসহ দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো নৌপথ ও লঞ্চ স্টেশনগুলোরও। নদ-নদীর নাব্য সংকটে দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৩০টি নৌপথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এ বছর শুষ্ক মওশুমে। বরিশাল-চাঁদপুর-ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামের সাথে বরিশাল ও মোংলাসহ সারা দেশের নৌযোগাযোগ রক্ষাকারী ভাটি মেঘনায় এখন ভয়াবহ নাব্য সংকট। ভোলা লক্ষীপুরসহ অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ নৌপথেও ঘুরে চলতে হচ্ছে প্রতিদিন বহু সংখ্যক নৌযানকে।
পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, মেঘনা ও তেঁতুলিয়ায় নাব্য সংকটে দেশের সবগুলো ফেরি রুটে চরম অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে। বছরের অন্তত ৮মাস ড্রেজিং করেও পাটুরিয়া ও মাওয়া নৌপথ সচল রাখা দুরুহ হয়ে পড়ছে।
নদ-নদীর প্রবাহ ও নাব্য সংকট দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য সম্পদকেও চরম ঝুঁকির মুখে নিয়ে যাচ্ছে। গত অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল প্রায় ৫লাখ টন। যার প্রায় ষাটভাগই পাওয়া গেছে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী থেকে। কিন্তু ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে তার অবদান কম। উজানে নদ-নদীর প্রবাহ সংকটে ইলিশ নিয়ে শংকিত মৎস বিশেষজ্ঞগন।

বিআইডবিøউটিএ’র নৌপথ সংরক্ষন ও পরিচালন বিভাগের সাবেক পরিচালক মো. এমদাদুল হক-এর মতে দেশের ১১৭টি নদ-নদীর ৪ হাজার ৬৬০কিলোমিটার নৌপথ ইতোমধ্যে হয় বন্ধ হয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে নদী ধ্বংসের হার আরো বাড়বে বলেও আশংকা প্রকাশ করেছেন তিনি। বর্তমানে আরো ২৫টি নদ-নদী অবধারিত অস্তিত্ব সংকটের মুখে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
নদÑনদী উন্নœয়ন ও সংরক্ষনের ওপর গুরুত্বারোপ করে ব্যাপক ড্রেজিং চালুর কথা বলেন। তবে এলক্ষ্যে তিনি পরিকল্পিত নদী খননের ওপরও তাগিদ দিয়েছেন। তার মতে নদী গবেষনা ইনস্টিটিটিউট, বুয়েট, সিইজিআইএস ও বিআইডবিøউটিএ যৌথভাবে কাজ করলে নদ-নদীর উন্নয়ন আরো সহজ হবে।

সীমান্তের ওপারে প্রবাহ হ্রাসের ফলে উজান হয়ে দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত নদী প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। নদী প্রবাহ পায়রা ও মোংলা সমুদ্র বন্দরের অস্তিত্ব, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন ভয়াবহ ঝুঁকির কবলে নিয়ে যাচ্ছে। মোংলা বন্দরের অবস্থান বঙ্গোপসাগর মোহনা থেকে ১১৩কিলোমিটার উজানে। উজানে পদ্মা হয়ে প্রথম শাখা নদী গড়াই এর সাথে সিবসায় প্রবাহ হ্রাসে মোংলা বন্দর থেকে সাগর মোহনা পর্যন্ত পলি জমার পরিমান বাড়ছে। এরফলে টার্নিং পয়েন্টগুলোসহ মূল চ্যানেলে গভীরতা সর্বোচ্চ ২৮ ফুটে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সর্বোচ্চ ৭৩৮ ফুটের বেশী দৈর্ঘের নৌযান মোংলা বন্দরে আসতে পারছে না। সুন্দরবনে লবনাক্ততা বৃদ্ধির ফলে সুন্দরীসহ অনেক প্রজাতীর গাছ ধ্বংস হচ্ছে। মিঠাপানির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে সুন্দরবন থেকে। মূল চ্যানেলে নাব্য সংকটও সৃষ্টি হচ্ছে প্রকটভাবে। যদিও সরকার গতবছর থেকে মোংলা বন্দরে কেপিট্যাল ড্রেজিং শুরু করেছে। তবে নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি না পেলে এ ড্রেজিং বন্দরের মূল চ্যানেলের গভীরতাকে কাঙ্খিত মাত্রায় ধরে রাখতে পারবে না। একই ধরনের হুমকির মুখে রয়েছে দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পায়রা’তেও। বরিশাল থেকে পায়রা বন্দরমুখি দুটি নৌপথই নাব্য সংকটে চরম বিপাকে ফেলছে বন্দরমুখি নৌযানের কাপ্তেনদেরও। তবে ফারাক্কা চুক্তি হলেও তিস্তা নিয়ে কোন চুক্তি হয়নি। উপরন্তু চুক্তি অনুযায়ী পানি না পাবার অভিযোগও রয়েছে। সীমান্তের ওপারে অন্যান্য নদী থেকে পানি প্রত্যাহারও দেশে মৎস সম্পদ, কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্যও ভয়াবহ হুমকি সৃষ্টি করেছে।
তবে সরকার গত কয়েক বছরে বিআইডবিøউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জন্য বেশ কিছু ড্রেজার সংগ্রহ করেছে। তবে নদী বিশেষজ্ঞদের মতে উজান থেকে প্রবাহ বৃদ্ধি না পেলে শুধু নদী খনন করে কোন ফল পাওয়া যাবেনা। এ লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞগন কুটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সীমান্তের ওপার থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন।

https://www.dailyinqilab.com/article/119950