৪ মার্চ ২০১৮, রবিবার, ১০:১১

অস্বাভাবিক বাড়ছে আমদানি

‘এক শ্রেণীর অসাধু আমদানিকারক এলসি খোলার সময় উচ্চমূল্য দেখাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে পরিশোধ করা হচ্ছে এর অনেক কম মূল্য। এভাবে আমদানিকারক এবং বিদেশি সরবরাহকারীর পারস্পরিক যোগসাজশে বড় ধরনের মুদ্রা পাচার হচ্ছে। বিশেষ করে অবৈধ পথে উপার্জিত আয় বৈধ করার সুযোগ না থাকায় ভিন্ন কৌশলে তা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।’

হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে পণ্য আমদানি। সে তুলনায় বাড়ছে না রফতানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ৪ হাজার ২৩ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এ অংক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্য ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি। মাত্রাতিরিক্ত এই আমদানিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই আমদানির পেছনে দেশ থেকে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। উচ্চ মূল্যে আমদানি দেখিয়েই অর্থপাচার বেশি হচ্ছে বলে জানা গেছে। যা ওভার ইনভয়েসিং হিসেবে পরিচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলসি খোলা যে হারে বেড়েছে, তার কোনো রেকর্ড অতীতে ছিল না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যাংকার জানান, আমদানি ব্যয় জাতীয় বাজেটকেও ছাড়াতে পারে। তার মতে, এক শ্রেণীর অসাধু আমদানিকারক এলসি খোলার সময় উচ্চমূল্য দেখাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে পরিশোধ করা হচ্ছে এর অনেক কম মূল্য। আমদানিকারক এবং বিদেশি সরবরাহকারীর পারস্পরিক যোগসাজশে বড় ধরনের মুদ্রা পাচার হচ্ছে। বিশেষ করে অবৈধ পথে উপার্জিত আয় বৈধ করার সুযোগ না থাকায় ভিন্ন কৌশলে তা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এটি কেন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন, ওভার ইনভয়েচিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে কিছু বাস্তবিক কারণও আছে। বৈশ্বিকভাবে তেলের দাম বৃদ্ধি, খাদ্য আমদানি বেড়ে যাওয়া এবং রূপপুরসহ সরকারের বড় প্রকল্পের কাজ অব্যাহত থাকা। তবুও এসবের আড়ালে অন্য কিছু হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
একজন অর্থনীতির গবেষক বলছেন, চলতি অর্থবছরে আমদানি খরচ ৬ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। বর্তমান দরে এই অর্থের পরিমাণ ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা; যা চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা এবং আগামী অর্থবছরের সম্ভাব্য বাজেটের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। আগের বছর যা ছিল ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চালের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে চাল আমদানিতে ১৩৮ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল মাত্র ১ কোটি ডলার। সে হিসাবে চালে এলসি খোলার হার বেড়েছে ১১ হাজার ৩৫১ শতাংশ। একই সময়ে গমের এলসি বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। পেঁয়াজ ৮০ শতাংশ, জ্বালানি তেল ২৭ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।

সিনিয়র ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন দেশ, কথাটি বারবার শোনা গেছে। তবুও এত খাদ্য আমদানি কেন? ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। এছাড়া অনুৎপাদনশীল কোনো পণ্য আমদানি করা হচ্ছে কিনা। কারণ মানুষের মাঝে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার একটা মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাস্তবসম্মত কারণে যে পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এছাড়া বড় প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতেও কোনো আপত্তি নেই। তবে এসবের আড়ালে কিছু হচ্ছে কিনা সেটাই হচ্ছে বড় ভয়।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বিআইডিএসের গবেষক ড. জায়েদ বখত যুগান্তরকে বলেন, রূপপুরসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এতে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে। এছাড়া প্রচুর চাল আমদানি করা হয়েছে। সে কারণে আমদানি বেড়েছে। এতে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন তিনি। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি ব্যয় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি মাসেই বাড়ছে আমদানি। বাড়ছে এলসি খোলার পরিমাণ। সব মিলিয়ে এবার আমদানি ব্যয় ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে বিপুল পরিমাণ এ আমদানির পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণও উল্লেখ করেন তারা। তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির যে উল্লম্ফন সেটা মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির কারণে বাড়ছে। এছাড়া চাল, জ্বালানি তেল, ক্যাপিটাল মেশিনারি এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়ার কারণেও আমদানি ব্যয় বাড়ছে। তবুও এর আড়ালে অন্য কোনো কারণ আছে কি না সে সন্দেহ পিছু ছাড়ছে না। ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। কিন্তু বাস্তবে বিনিয়োগ বাড়ছে না। তাদের আরও দাবি, অনেক সময়ই শুনি, এক পণ্য আমদানির নামে অন্য পণ্য আমদানি হচ্ছে। কখনও শূন্য কন্টেইনারও আসছে। আবার ওভার ইনভয়েসের (আমদানি করা পণ্যের বেশি মূল্য দেখিয়ে) মাধ্যমে অর্থ পাচার করছেন অনেকে। সে কারণেই আমদানি বাড়াকে শুধু ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছি না। কারণ আমদানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও রেমিটেন্স ও রফতানি আয় বাড়ছে ধীর গতিতে।

গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কী পরিমাণ পণ্য বা যন্ত্রাংশ আমদানি হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই সময়ে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানি বেড়েছে ২১২ শতাংশ। ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/23836