৪ মার্চ ২০১৮, রবিবার, ১০:১০

হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ ৬০ ভাগও শেষ হয়নি

দায়সারা কাজ ও ভুয়া প্রকল্পের অভিযোগ * বোরো নিয়ে শঙ্কা, কৃষকদের বিক্ষোভ সমাবেশ

হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ চলছে ধীরগতিতে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের শতভাগ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ৬০ ভাগও হয়নি। অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ বলছে, গড়ে ৬৫ থেকে ৬৭ ভাগ কাজ হয়েছে এবং ১৫ দিনের মধ্যে শতভাগ শেষ হবে। হাওরাঞ্চলে দ্রুত বাঁধ নির্মাণে সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে রেকর্ড পরিমাণ বরাদ্দ দিলেও কাজের গতি ও মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। দায়সারা কাজ ও প্রভাবশালীদের পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক ভুয়া প্রকল্প তৈরির অভিযোগও উঠেছে। কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ করতে না পারায় আবারও ফসল হানির শঙ্কা করছে কৃষকরা। হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন।

সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি উপজেলায় হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাঁধ মজবুত করতে স্তরে স্তরে দুরমুশ করা ও ঘাস লাগানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ স্থানে বাঁধের ঢালের (স্লোপ) কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। নিয়ম না মেনে বাঁধের কাছ থেকে কাটা হচ্ছে মাটি। আবার অপ্রয়োজনীয় স্থানে বাঁধ নির্মাণ করে টাকা অপচয়েরও অভিযোগ আছে। হাওর গবেষক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ৩ দিনে ১৭টি বাঁধ ঘুরেছি। কোথাও নীতিমালা মোতাবেক কাজ হয়নি। অনেক বাঁধে এখনও মাটি ফেলাই হয়নি। বাঁধে দুরমুশ ও স্লোপ করা হয়নি বললেই চলে। মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রভাবশালীদের দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করায় সাধারণ মানুষ এসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলতেও সাহস পান না।

‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান যুগান্তরকে বলেন, হাওরের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বোরো ফসল নিয়ে আমরা শঙ্কিত। জেলার তিনটি উপজেলার অন্তত ৪০টি হাওর রক্ষা বাঁধ পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, বাঁধ নির্মাণে নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে না। কোনো বাঁধেই ঠিকমতো স্লোপ, দুরমুশের কাজ চোখে পড়েনি। সর্বত্র দায়সারাভাবে কাজ করতে দেখা গেছে। তিনি বলেন, সময় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনিটরিং আরও জোরালো না করলে ১৫ দিনে বাঁধের কাজ শেষ করা কঠিন হবে। সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, এবার হাওর থেকে পানি নামতে প্রায় এক মাস বিলম্ব হয়েছে। এজন্য বাঁধ নির্মাণের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। এ পর্যন্ত গড়ে প্রায় ৬৭ ভাগ কাজ হয়েছে। আশা করছি, ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় শতভাগ কাজ শেষ করতে পারব। বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, যথানিয়মে কাজ না করে পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। বাঁধ নির্মাণে ত্রুটি হলে এর দায় পিআইসি ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে। তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয় পিআইসি থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গত মৌসুমে বাঁধ নির্মাণে পাউবো ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় ঠিকাদার প্রথা বাতিল করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। স্থানীয় কৃষকদের সমন্বয়ে গঠিত পিআইসির মাধ্যমে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। আগে পাউবো কর্মকর্তা এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ায় কিছুটা নাখোশ পাউবো কর্মকর্তারা। অভিযোগ, পাউবো কর্মকর্তারা নানা টালবাহানা করে সময় নষ্ট করছেন। তারা দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। পিআইসি কমিটি বলছে, হাওরের পানি না নামায় বাঁধের কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পাউবো ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় বাঁধ নির্মাণে দেরি হচ্ছে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরু হয়।

গত বছর অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। এজন্য জেলার ১১ উপজেলায় ১১৫টি ক্লোজার এবং ১৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ১৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। এরই মধ্যে ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বাকি টাকা পাওয়ারও আশ্বাস মিলেছে মন্ত্রণালয় থেকে। এ অঞ্চলে এত বরাদ্দ এবারই প্রথম। গত বছর ঠিকাদার ও পিআইসি মিলে বরাদ্দ পায় ৬৪ কোটি টাকা। এবার ৯৬৮টি পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির) মাধ্যমে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। এবার আর্থিক সমস্যা না থাকলেও প্রতিটি উপজেলায় বাঁধের কাজে ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া কাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার হাওর বাঁচাও কমিটির সদস্য সচিব জয়ন্ত সেন বলেন, কোনো বাঁধেই ঠিকমতো স্লোপ করা হচ্ছে না, দুরমুশ করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, শাল্লায় ৪০ ভাগের মতো কাজ হয়েছে। কাজের গতি না বাড়ালে বৃষ্টির সময় এসব বাঁধ সঠিকভাবে নির্মাণ করা যাবে না। গতবারের মতো এবারও ফসলহানি ঘটতে পারে।

‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আলাউদ্দিন বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় কৃষকের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। দ্রুততম সময়ে বাঁধের কাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের আরও আন্তরিক হওয়ার দাবি জানান তিনি। জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলেন, যথাসময়ে বাঁধের কাজ শেষ করার জন্য কাজ করছি। তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রকল্প মনিটরিং কমিটির সভাপতি পূর্ণেন্দু দেব জানান, টেকনিক্যাল কিছু সমস্যার কারণে কয়েকটি বাঁধের কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে। পিআইসিদের জোর তাগিদ দিয়েছি কাজ শেষ করতে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রকল্প মনিটরিং কমিটির উপদেষ্টা কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, সরেজমিন সব বাঁধ দেখেছি। এখন পর্যন্ত একটি বাঁধের কাজও শতভাগ সমাপ্ত হয়নি। কাজ দ্রুত শেষ করা না গেলে এবারও ফসল রক্ষা করা কঠিন হবে।

নেত্রকোনায় বাঁধ নির্মাণে ৯৪৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাত্র ৪৫০টির কাজ শেষ হয়েছে। অধিকাংশ বাঁধেই ৫০ থেকে ৬০ ভাগের বেশি কাজ হয়নি। এছাড়া প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে বরাদ্দ তছরুপের অভিযোগও উঠেছে। মাটির বদলে বালি দিয়ে বাঁধ তৈরিরও অভিযোগ রয়েছে। খালিয়াজুরী উপজেলার চাকুয়া ইউনিয়নের ধনু নদীর কূল ঘেঁষা প্রকল্পে দেয়া হয়েছে বালির বাঁধ। একই ইউনিয়নের সমীরপুর বাঁধ নির্মাণে ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে টাকা তছরুপের অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় বড় বড় হাওর এলাকায় স্থানীয় কৃষকরা বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন। বৃহস্পতিবার পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে কৃষকরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত এক কোদাল মাটিও পড়েনি অর্ধেকের বেশি বাঁধে। তবে রোববারের বৃষ্টির পর তড়িঘড়ি করে কয়েকটি এলাকায় বাঁধের সংস্কার কাজ শুরু করে পাউবো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, বন্যার আগেই কাজ শেষ হবে। মোহনগঞ্জ উপজেলার ভাটিপাড়া এলাকার কৃষক জনাব আলী বলেন, ঢল আসা শুরু হলে তাড়াহুড়া করে বাঁধে মাটি ফেলার ব্যবস্থা করা হয়।

জামালগঞ্জের হালির হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার কালীবাড়িতে ৭০ ভাগ কাজ হয়েছে। তবে দুরমুশ হয়নি বললেই চলে। এ হাওরের মামদপুর বাঁধেরও একই অবস্থা। মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপুতা হাওরের ৭০ মিটার অংশে এখনও কাজ শুরু করা হয়নি। বেকা বাঁধে ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ কাজ হয়েছে। হাওরপাড়ের উত্তরের বাঁধে ৫০ ভাগ কাজ হয়েছে। খালিয়াজুরি উপজেলার পাঙ্গাসিয়া হাওরের পাশের ধনু নদের পাড়ের বাঁধের কাজ এখনও শেষ হয়নি। সিপিবির জেলা শাখার সভাপতি নলিনী সরকার বলেন, ৩ দিনে ১৭টি বাঁধ ঘুরেছি, অনেক বাঁধে এখনও মাটিই ফেলা হয়নি। কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল বাশার বলেন, মোহনগঞ্জ, ধর্মপাশার হলদির হাওরের ছয়টি পিআইসিতে বরাদ্দ প্রায় দুই কোটি টাকা। অথচ বাঁধ সংস্কার যেভাবে করা হয়েছে, তাতে পানির প্রথম ধাক্কায়ই বাঁধ ভেসে যাবে। বাঁধের গোড়া থেকে মাটি তোলা হয়েছে। দুরমুশ করা হয়নি।
‘হাওর বাঁচাও, নেত্রকোনা বাঁচাও’ আন্দোলনের জেলা কমিটির সভাপতি খন্দকার আনিছুর বহমান বলেন, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, ৬৭ ভাগ কাজ হয়েছে। বাকি কাজ করবে কখন? গত বছর হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়ায় নীতিমালা বদল করা হল। সরকার বাঁধ নির্মাণে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিল। কিন্তু কাজের অবস্থা দেখে হতাশ হতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমান বলেন, পানি না নামার কারণে বাঁধের কাজ শুরু করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। প্রকৃতি ও অবস্থানগত ভিন্নতার কারণে কাজ শুরু করতে কিছুটা দেরি হয়।

পরিবেশ ইন্সটিটিউটের সভাপতি প্রকৌশলী ম. এনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, বাঁধ নির্মাণে দেরি করার বৃত্ত থেকে পাউবো বেরোতে পারেনি। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের কোন্দল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব এজন্য দায়ী। এবার ধান দেরিতে লাগানো হয়েছে। তাই ঝুঁকিটা বেশি। ধান কাটতে যত সময় লাগবে ফসল হানির আশঙ্কা তত বাড়বে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জান জানান, বাঁধের ৫৬ ভাগ কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতি বছরই সময় বাড়ানো হয়। কাজ না করে পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ না হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যুগান্তরকে মোবাইল ফোনে বলেন, হাওরে এবার পানি নামতে দেরি হয়েছে। পানি সরিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে। এবার ভালোভাবে কাজ হচ্ছে, তাই একটু সময় লাগছে। বন্যার সময় পানি যাতে দ্রুত সরে যেতে পারে সে জন্য দুটি খাল নির্মাণ করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/23736