৪ মার্চ ২০১৮, রবিবার, ১০:০৯

ঋণের উচ্চ সুদের করাল গ্রাস

ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিট অতিক্রম করেছে অধিকাংশ ব্যাংক, কোনো কোনো ব্যাংকে এ হার ১৪-১৬ শতাংশ * ঋণখেলাপির দায় ভালো উদ্যোক্তারা কেন নেবেন -বিশ্লেষকদের মন্তব্য * লুটপাটের মাশুল ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে -দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন

ফের ঋণের উচ্চ সুদের করাল গ্রাস চেপে বসেছে বিনিয়োগকারীসহ বিভিন্ন খাতের ঋণগ্রহীতাদের ওপর। ইতিমধ্যে অধিকাংশ ব্যাংকে ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিট অতিক্রম করেছে। কয়েকটি ব্যাংক আগ্রাসী স্টাইলে ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে। যেখানে ঋণের সুদ ১৪-১৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এভাবে ঋণের উচ্চ সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে ভুক্তভোগীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যুগান্তরকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো দুর্নীতি ও ঋণ জালিয়াতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে ঋণখেলাপিদের বোঝা ভালো মানের ঋণগ্রহীতাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা কমিশন নিয়ে অপাত্রে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে। এখন সেসব খেলাপি ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে উল্টো অন্যদের ওপর বেশি হারে সুদ চাপিয়ে দিচ্ছে। এমন সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নেবে না। তারা বলেন, বেশি বাড়াবাড়ি করা হলে অতিরিক্ত সুদ দেয়া তো দূরের কথা কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেয়া হবে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ১৪ শতাংশ সুদের কমে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ব্যাংক ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। এমনকি সুদহার বাড়ানোর খবরও জানানো হয় না। তিনি বলেন, লুটপাটের মাশুল ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, নিয়মনীতি না মেনে বেশিরভাগ ব্যাংক অসাধু ব্যবসায়ীদের বাল্ক ঋণ দিয়েছে। সময়মতো কিস্তি পরিশোধ তো দূরের কথা, তারা যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছে বাস্তবে তার কোনো হদিসও মিলছে না। সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে দেয়া এসব ঋণ এখন ব্যাংকগুলোর গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অবলোপন করেও সামাল দিতে পারছে না। অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণের কারণে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে এসব বিপথগামী ব্যাংক। ইতিমধ্যে একটি ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারায় আস্থাহীনতা চরমে উঠেছে। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, অনেকে এখন ব্যাংকে টাকা রাখতেও ভয় পান। কিন্তু এর দায় ভালো ব্যবসায়ীরা নেবেন না, কেন তাদেরকে উচ্চ সুদ দিয়ে মাশুল গুনতে হবে- এমন প্রশ্ন করেছেন কয়েকজন ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার এভাবে বাড়িয়ে দেয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ ব্যাংকাররা নিজেদের দোষে বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণে আটকে আছে। সে মাশুল অন্যদের ঘাড়ে চাপানো ঠিক হচ্ছে না। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়ানোর অজুহাতে ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আমানতের সুদ তত বাড়ায়নি, যত বাড়াচ্ছে ঋণের সুদহার। তিনি মনে করেন, এটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ যুগান্তরকে বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অপরিপক্ব দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনার কারণে এমনটি হচ্ছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশিষ্ট ব্যাংককার যুগান্তরকে বলেন, দেশে ব্যাংকিং খাতে কোনো সুশাসন নেই। বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে নিয়ে গেছে। এভাবে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার হলে ব্যাংক ধীরে ধীরে অর্থশূন্য হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, বিদেশি কোনো ব্যাংকে এমন হয় না। কিন্তু শুধু দেশি ব্যাংকে কেন এমন দুর্নীতি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, অধিক পরিমাণ খেলাপি ঋণের লোকসানের বোঝা সামাল দিতে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা অত্যন্ত খারাপ কাজ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য কোনো পদ্ধতি বের করতে পারে কিনা, তা খতিয়ে দেখা উচিত। তবে ভালো ব্যবসায়ীদের সুবিবেচনায় রাখতে পারে। সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক সমন্বয় করবে।

ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান (এবিবি) ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঋণ অনিয়ম এবং কয়েকটি ব্যাংক আগ্রাসীভাবে বিনিয়োগ করায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। কিছুটা আস্থাহীনতাও রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত তুলে নিচ্ছে। এ ছাড়া বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকিং খাত কিছুটা চাপে আছে। এসব কারণে ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিট অতিক্রম করেছে। তার দাবি, এখনও বড় ঋণের সুদ ১০-১২ শতাংশে রয়েছে। বেশি বেড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। অন্যভাবে সমন্বয় করা যায় কিনা সে দিকটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাংঘর্ষিক নীতির কারণে সুদের হার বাড়ছে। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নিয়েছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে ডাবল ডিজিটে ঋণের সুদ নিয়েছে ১৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। ইতিমধ্যে তা ক্ষেত্রবিশেষে ১৪-১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার কষছে কয়েকটি ব্যাংক। এদিকে উচ্চ সুদহার বাড়ানোর তালিকায় রয়েছে ফারমার্স ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল, ন্যাশনাল ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক প্রভৃতি। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদের হার ডাবল ডিজিটে চলে এসেছে। কারণ কিছু ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। সে কারণে আমানত সংগ্রহে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সবাই আমানতের সুদ বাড়িয়ে দিয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/23729