৩ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৯:৩৭

নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে টেন্ডারে বিশেষ শর্ত

নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে টেন্ডারে বিশেষ শর্ত আরোপ করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। ‘বিনা অপারেশনে জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা কার্যক্রম’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে দরপত্রে (টেন্ডার) বিশেষ শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে টেন্ডারে একটি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
১৮ জানুয়ারি ইস্যু করা টেন্ডার জমা দেয়ার শেষ সময় ছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি। ই-টেন্ডার সুবিধা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-ব্লকের ৪০৩ নম্বর কক্ষে টেন্ডার জমা দিতে বলা হয়। নির্ধারিত সময়ে চারটি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নিলেও তিনটি প্রতিষ্ঠান একই মালিকের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রায় ৪ কোটি টাকা মূল্যমানের এ টেন্ডারে দুটি লটে ৩২ ধরনের চিকিৎসা উপকরণ কেনা হবে। মূলত জন্মগত শিশু হৃদরোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার সেবা দিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য এ টেন্ডার আহ্বান করা হয়। টেন্ডারে কিছু দামি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। এগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্যই ‘ইউএস এফডিএ’ অনুমোদিত হতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। তবে অপেক্ষাকৃত কম দামের সরঞ্জামের ক্ষেত্রে ইউএস এফডিএ’র পাশাপাশি সিই অ্যাপ্র“ভড হলেও চলবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা গেছে, দেশে শিশু হৃদরোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন ডিভাইস ও সরঞ্জাম আমদানি এবং সরবরাহ করে এমন প্রতিষ্ঠান হাতেগোনা ৫ থেকে ৬টি। এরমধ্যে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ডিভাইস আমদানি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটিই ইউএস এফডিএ অনুমোদিত। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চিকিৎসক যুগান্তরকে জানান, মেডিকেল ডিভাইস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সহায়তায় (অনুদান) হৃদরোগ চিকিৎসকরা নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন। এছাড়া প্রতিটি ডিভাইস বিক্রির ওপর তারা মোটা অংকের কমিশন পেয়ে থাকেন। এ কারণে টেন্ডার বা সরবরাহের ক্ষেত্রে যে কোম্পানির ডিভাইসের দাম বেশি তাদের পণ্যের প্রতি চিকিৎসকদের বিশেষ দুর্বলতা থাকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালের নভেম্বরে একই জাতীয় মেডিকেল ডিভাইসের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল। যেখানে মানসম্পন্ন ডিভাইসের শর্ত হিসেবে ‘ইউএসএফডিএ’ ও ‘ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সার্টিফাইড (সিই)’ উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বিএসএমএমইউ’র ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ডিভাইসের ক্ষেত্রে শুধু ‘ইউএসএফডিএ’ অনুমোদনের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান মার্কিন প্রতিষ্ঠানের ডিভাইস আমদানি করে। বাকিগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশের তৈরি ডিভাইস আমদানি করে। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও তুরস্ক। এসব দেশের মেডিকেল ডিভাইস সারা বিশ্বে সমাদৃত। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে পাশাপাশি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনেও ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সার্টিফাইড ডিভাইস ব্যবহার করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক হৃদরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ যুগান্তরকে বলেন, ইউএসএফডিএ অনুমোদিত ডিভাইসের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এসব ডিভাইস খুব কম ব্যবহার হয়। রোগীদের সুবিধার্থে একই মানের ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সার্টিফাইড ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। জার্মান, ইংল্যান্ড বা সুইজারল্যান্ডের ডিভাইসগুলো সর্বোচ্চ মানের নিশ্চয়তা প্রদান করে। তবে দাম অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও চীন অথবা ভারতের ডিভাইস ব্যবহার হয় না।

জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাফি আল মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ইউএসএফডিএ হল মেডিকেল পণ্যের গুণগতমান। ইউএসএফডি অনুমোদিত হলে বুঝতে হবে পণ্যটি গুণগত মানসম্পন্ন। তবে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সার্টিফাইড ডিভাইসকে মানহীন বলার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে ডিভাইসটি যেন চীন অথবা ভারতের নিম্নমান সম্পন্ন না হয়।
টেন্ডার ডকুমেন্টে দেখা গেছে, প্রথম লটে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওয়াক ক্যাথেটেরাইজেশন ১৬টি আইটেমের ক্ষেত্রে ইউএসএফডিএ এবং সিই অনুমোদিত হতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় লটের এক থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ডিভাইসের ক্ষেত্রে শুধু ইউএসএফডিএ অনুমোদিত হতে হবে এমন শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। তবে লটের ১৫ ও ১৬ নম্বরে কাভার্ড স্টান্ট ও আরভিওটি স্টেন্টের ক্ষেত্রে আবার ইউএসএফডিএর পাশপাশি সিই অনুমোদিত হলে চলবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যে ডিভাইসগুলোর ক্ষেত্রে এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এএসডি (আট্রিয়ায় ফেটাল ডিফেক্ট) ডিভাইস রয়েছে ১৫০টি। শিশুদের হার্টের ওপরের দিকে ছিদ্র বন্ধ করার কাজে এসব ব্যবহৃত হয়। ইউরোপিয় স্টান্ডার্ড এ ধরনের ডিভাইসটি বাজার মূল্য এক লাখ ১০ থেকে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। সেখানে ইউএসএফডিএ’র একটি ডিভাইস’র দাম পড়বে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা। একইভাবে ২৫০টি পিএডি ডিভাইস কেনা হবে। সিই ডিভাইসের দাম পড়বে ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা সেখানে ইউএসএফডিএ’র দাম পড়বে একলাখ ১০ হাজার টাকা। অন্য ডিভাইসগুলোর দামের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পার্থক্য রয়েছে বলে তারা জানান।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘বিনা অপারেশনে জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা কার্যক্রম’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ইউএসএফডিএ সবচেয়ে ভাল। তাই টেন্ডারে এই শর্ত দেয়া হয়েছে। রোগীর শরীরে অবশ্যই ভালটি ব্যবহার করব। সব ডিভাইসের ক্ষেত্রে কেন এ শর্তজুড়ে দেয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সরকারি নীতিমালা মেনেই টেন্ডার আহবান করেছি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/23387