২ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৫৯

উপসম্পাদকীয়

সংবাদপত্রের সততা ও নিরপেতা

শাহ্ আব্দুল হান্নান

সংবাদপত্রের একজন নিয়মিত পাঠক হওয়া সত্তে¡ও আমি কেন যেন, কখনো সংবাদপত্রের সততা ও নিরপেতার ওপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। যখনই সংবাদপত্রের সততা ও নিরপেতার প্রশ্ন আসে তখন কেউ কেউ বলেন, ‘নিরপেতা’ বলে কিছু নেই এবং এ কথা বলে নিরপেতার গুরুত্বকে খাটো করার চেষ্টা করেন। কেউ এটিও বলতে চান যে, নিরপেতা মানে মুনাফিকি। আসলে এটি হচ্ছে, বিষয়টির অতি সরলীকরণ। প্রকৃতপে এটি ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা; নিরপেতার যে প্রয়োজনীয়তা তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মিডিয়ার দায়িত্ব জনগণকে সত্য তথ্য অবহিত করা এবং তাদের যে এডিটোরিয়াল পলিসি তা যথাসম্ভব সততার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া। কোনোভাবেই মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে এডিটোরিয়াল কমেন্ট করা ঠিক নয়। এডিটোরিয়াল অবশ্যই সত্যের ওপর ভিত্তিশীল হতে হবে।
সংবাদপত্রগুলো যে দৃষ্টিভঙ্গি ফলো করে, তাতে পাঠক হিসেবে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমরা বিশ্বব্যাপী এক শ’ বছর ধরে নৈতিক সঙ্কটের অভাব বোধ করছি। বিশেষ করে এটি শুরু হয়েছে যখন থেকে শিাকে সেকুলারাইজ করা হয়। অর্থাৎ শিা থেকে নৈতিকতাকে যে সময় থেকে বাদ দেয়া হয়, খাটো করে দেখা হয়, তখন থেকেই প্রকৃতপে বিশ্বব্যাপী নৈতিক সঙ্কট শুরু হয়েছে। এ নৈতিক সঙ্কটের ফল হচ্ছেÑ বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি, সামাজিক েেত্র দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্নীতি আর আন্তর্জাতিক নীতিতে দুর্নীতি বা মুনাফিকি। আন্তর্জাতিক েেত্র যে দুর্নীতি, ডিপ্লোম্যাসির নামে যে নীতিহীনতাÑ এটি আজ ব্যাপক হয়ে উঠেছে এবং ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। এ নৈতিক সঙ্কটের প্রতিফলন ঘটছে সংবাদপত্রে। এর প্রভাব পড়ছে সার্বিকভাবে মিডিয়ায়। এটি আলাদা কিছু নয়; তারই একটি অংশ মাত্র। বিষয়টি আমাদের এভাবেই বিবেচনা করতে হবে।
বিবিসি, সিএনএনের অন্যান্য অনুষ্ঠান (যা অনেক েেত্র অশ্লীল) বাদ দিয়ে যদি শুধু প্রতি ঘণ্টায় পরিবেশিত সংবাদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবÑ তারা সংবাদ পরিবেশনের েেত্র খুবই পপাতিত্ব করে থাকে। বিশেষ করে ইস্যুটি যদি মুসলিম বিশে^র বা তৃতীয় বিশ্বের হয়, তাহলে তাদের নিরপেতা ও সততা এ েেত্র থাকে না বললেই চলে। যদি উত্তর কোরিয়ার ব্যাপার হয়, তাহলে তারা তিলকে তাল করে। আফগানিস্তান, ইরাক ও ফিলিস্তিনের ব্যাপারে তারা নিরপে থাকে না। এসব মিডিয়া তাদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ ইস্যুগুলোতে একপেশে নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। অনেক েেত্রই তারা তাদের ইচ্ছা ও সুবিধামতো পপাতিত্ব করে থাকে। কোনো ব্যক্তি যদি এক েেত্র দুর্নীতিপরায়ণ হয়, তাহলে তার কাছ থেকে অন্য েেত্র আমরা নীতিবোধের আশা করতে পারি না। এটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একটি দিক।
আবার বিদেশী সংবাদপত্রগুলোর দিকে তাকালেও এ রকম চিত্রই আমরা দেখব। সব বিদেশী পত্রিকা আমার পড়া সম্ভব হয় না; কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত তিনটি পত্রিকার মাধ্যমে বিষয়টি বিচার করতে পারি। পত্রিকা তিনটি হলোÑ ‘দি ইকোনমিস্ট’, ‘টাইমস’ ও ‘নিউজউইক’। এ তিনটি পত্রিকাই মানের দিক থেকে ভালো ও তথ্যসমৃদ্ধ। সাধারণ লোক বুঝতেই পারবে না, এর ভেতরে কী ধরনের তথ্যবিভ্রান্তি ঢুকে আছে। একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন, কিভাবে এগুলোতে তথ্য বিকৃতি করা হচ্ছে। অবাক হতে হয়, এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে খ্যাত ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকাটি যখনই তৃতীয় বিশ্ব বা মুসলিম ইস্যু আসে তখন আর জাস্টিস করতে পারে না বা সততা দেখাতে ব্যর্থ হয়। ওই একই ব্যাপারÑ তাদের কাছেও উত্তর কোরিয়া ‘শয়তান’; ইসরাইল আণবিক অস্ত্র বানালেও ‘শয়তান’ নয়। যদি উত্তর কোরিয়ার পাশে চীনের মতো একটি দেশ না থাকত তাহলে আমেরিকা যে এত দিনে উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করত না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। এ কথা সত্য যে, উত্তর কোরিয়ার ওপর আক্রমণ চীন অনেকটা আটকে রেখেছে।
ইকোনমিস্টকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ইরাক যুদ্ধ সমর্থন করতে দেখা গেছে। দুর্বল শক্তি ইরাক একটি সবল শক্তির প্রেসারের সম্মুখীন। ইরাক সব সময় তার ওপর হামলার আতঙ্কের সম্মুখীন। সে অবস্থায় ইকোনমিস্টের মতো একটি পত্রিকা তার এডিটোরিয়ালে একবার নয়, ১০ বারেরও বেশি আমেরিকাকে উসকানি দিয়েছে। তারা বলেছে, যুদ্ধ করতে হবে, যুদ্ধ করাই সমাধান, যুদ্ধ ছাড়া এ ইস্যুর সমাধান নেই। আমি এ কথা বলি না যে, ইকোনমিস্টের কারণেই যুদ্ধ হয়েছে। ইকোনমিস্টকে রেসপনসিবল পত্রিকা বলা হয়। কিন্তু এত বড় উসকানিতে এই পত্রিকাকে কোনোভাবেই রেসপনসিবল বলতে পারি না। এর কাজ বরাবরই ইরেসপনসিবল ছিল। আফগানিস্তানের ব্যাপারেও পত্রিকাটি উসকানি দিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারেও একই ধরনের উসকানি তারা সম্ভবমতো দিচ্ছে। এ দিক থেকে সংবাদপত্রের খুব ভালো একটি ভূমিকা আমি পাই না।
আবার দেশের সংবাদপত্র সম্পর্কে বলতে গেলে খুব সাবধানেই কথা বলতে হয়, যাতে দেশীয় রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গে জড়িয়ে না পড়ি।
আগেই বলেছি, এখানকার এডিটোরিয়াল পলিসি খুব একটি ফেয়ার বলা যায় না। সংবাদের েেত্র এখানে ঘটনাকে খুব বেশি ফলাও করে বা কম করে দেখানোর অভিযোগে কম-বেশি প্রায় সব পত্রিকা জড়িত। আমি বুঝি না, এটি কী করে ফেয়ার রিপোর্টিং হয়? তারা কী করে দাবি করবে যে, তাদের পত্রিকা সৎ ও নিরপে?
অন্য দিকে সংবাদপত্রগুলো বেশির ভাগ েেত্রই দেখা যায়, ইসলামিস্টদের তারা বলছে ‘সা¤প্রদায়িক সন্ত্রাসী’। ‘সা¤প্রদায়িক’ টাইটেল দিয়ে এটিকে তারা বিশেষভাবে প্রচার করতে থাকবে; কিন্তু আমরা জানি, ইসলামি সংগঠনগুলো কোনো ধরনের সা¤প্রদায়িকতার সাথে জড়িত নয়; কিন্তু সংবাদপত্রগুলো এটিই সব সময় বলে যাবে। এ মহলটি সা¤প্রদায়িক তো নয়ই এবং সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িত থাকারও কোনো প্রমাণ নেই। তারা সব সময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তা সত্তে¡ও তাদেরকেই সব সময় ‘সা¤প্রদায়িক’ ও ‘সন্ত্রাসী’ বলা হয়। এসব রিপোর্টিং রাজনৈতিকভাবে রঞ্জিত এবং আইডিওলজিক্যালি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাদের ভাষায় কোনো হিন্দু বা বৌদ্ধ সা¤প্রদায়িকতা নেই। তাদের কাছে সা¤প্রদায়িকতা মানে ইসলাম। এটি হয়ে গেছে। একে আমরা কোনোভাবেই পত্রিকাগুলোর জন্য সততা বা নিরপেতা বলতে পারি না।
তেমনিভাবে কোনো ইসলামিস্টের ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ বা ‘রামবাবুদের কারসাজি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করাকে ভালো বলা যায় না। আর এগুলো ইসলামিস্টদের মানায় না। তাই এগুলো বলা উচিত নয়। এমন নাম দেয়া ভালো নয়, যা লোকে পছন্দ করে না। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, কোনো একদিনের পত্রিকা হাতে নিলে দেখা যাবে, কিভাবে এখানে রিপোর্টিং খুব পপাতমূলক ও একপেশে হচ্ছে। প্রায় কোনো পত্রিকাই এ দোষ থেকে মুক্ত নয়। এটিই বেদনার কথা, দুঃখের কথা।
কিন্তু এর কি কোনো সমাধান নেই? আমার মন বলে, বিশ্বে এবং বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমাধান দেখছি না। তবে এ রকম একটি হতাশাব্যঞ্জক কথা দিয়ে শেষ করা কোনোভাবেই ঠিক নয়; কল্যাণকরও নয়। সেদিক থেকে মানবজাতির মধ্যে নৈতিকতাকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ কাজ বিশ্বব্যাপীই হতে হবে। নৈতিকতা যদি বিশ্বব্যাপী কিংবা স্থানীয়ভাবে ফিরিয়ে আনা না যায়, তাহলে এর কোনো সমাধান নেই। এ অবস্থার উত্তরণও সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাপী নৈতিকতাকে ফিরিয়ে আনা বা নৈতিকতার বিজয় অর্জন, এটি তো অনেক বড় কথা। ছোট করে বললেও বলতে হয়, বাংলাদেশের একদল সিনিয়র সাংবাদিক যারা নৈতিকতায় বিশ্বাস করেন, তাদেরকে একটি শক্ত আন্দোলন করতে হবে। যেমন আমরা দেখছি ফিল্মস্টারদের মধ্যেই একদল অশ্লীলতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। তেমনিভাবে আমি মনে করি, সংবাদপত্রের ভেতরও একদল সিনিয়র সাংবাদিককে খুব দৃঢ় মনোবল নিয়ে সততা ও নিরপেতার পে আন্দোলন করতে হবে। সেই সাথে আমাদের প্রেস ইনস্টিটিউট, যেখানে সাংবাদিকদের প্রশিণ দেয়া হয়, সেখানে অন্যান্য নিয়মিত বিষয়ের সাথে প্রশিণ দিতে হবে সততা ও নিরপেতার ওপর। আমার মনে হয়, সাংবাদিকদের প্রশিণের সবচেয়ে বড় দিক হতে হবেÑ নিজের মত ও পথের ঊর্ধ্বে উঠে সততা দেখানো। যেমনÑ আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, ‘তুমি সত্যের পথে সাী হওÑ তা যদি তোমার নিজের বিরুদ্ধেও হয়, তোমার আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়, তোমার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধেও হয়।’ (সূরা নিসা : ১৩৫)।
এই যে নীতিমালার কথা আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, তা-ই সংবাদপত্রের েেত্র ভিত্তি হওয়া উচিত।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/298146