২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:১৮

ড্রেজার ক্রয়ে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে শর্ত পরিবর্তন

২৬৮ কোটি টাকার দরপত্রে অনিয়ম

এমন শর্ত দেয়া হয়েছে যে, দেশীয় একটি কোম্পানি ছাড়া আর কেউ দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না

পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে ২৬৮ কোটি টাকায় ১২টি ড্রেজার ক্রয়ের দরপত্রে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এ ড্রেজার ক্রয়ে আহ্বান করা প্রথম দরপত্রে বিশেষ একটি কোম্পানি অংশ না নেয়ায় তা বাতিল করে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু প্রথমবার আহ্বান করা দরপত্রে যেখানে দরদাতার বিদেশি অংশীদারের ক্ষেত্রে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়, সেখানে দ্বিতীয় দফায় ২০ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় বিডারের ৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগে আন্তর্জাতিকভাবে ড্রেজার সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হলেও দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, মোট দরের ৮০ শতাংশ একক কাজ করার (সিঙ্গেল কন্ট্রাক্ট) অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোম্পানিই এ দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। অর্থাৎ যে কোম্পানি একসঙ্গে এক টেন্ডারে ২১৫ কোটি টাকার (২৬৮ কোটি টাকার ৮০ শতাংশ) ড্রেজার সরবরাহের কাজ করেছে শুধু তারাই এ দরপত্রে অংশ নিতে পারবে।
এ সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এরকম কাজ করার অভিজ্ঞতা একটিমাত্র কোম্পানিরই রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ওই কোম্পানিকে কাজ দিতেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সিন্ডিকেট দ্বিতীয় দফার দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের একটি শিপইয়ার্ডের মালিক যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে দেশে ৭-৮টি বড় কোম্পানি রয়েছে যারা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে এসব দরপত্রে অংশ নিতে পারে। কিন্তু পাউবির নতুন শর্তের কারণে একটি কোম্পানি ছাড়া আর কেউ অংশ নিতে পারবে না। এ অবস্থায় অবিলম্বে এ দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বানের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। অন্যথায় এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করবেন এবং একই সঙ্গে বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিতভাবে জানাবেন।
তবে ১২টি ড্রেজার ক্রয় প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সরকারি ক্রয় নীতিমালার (পিপিআর) শর্তানুযায়ী মূল বিডারের সিঙ্গেল টেন্ডারে ৮০ শতাংশ কাজ করার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ড্রেজার খুবই স্পর্শকাতর ইকুইপমেন্ট। যাতে ইউরোপীয় মানের কোম্পানিগুলো দরপত্রে অংশ নিতে পারে সে জন্য অভিজ্ঞতা ২০ বছর করা হয়েছে। তবে স্থানীয় বিডারের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে ৫ বছর। জয়েন্টভেঞ্চারে দেশীয় কোম্পানিগুলো অংশ নিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে ড্রেজারের ডিজাইন, ইকুইপমেন্ট, স্পেয়ার পার্টস, সংযোজন, প্রকৌশলীসহ সবকিছুই ইউরোপীয় মানের হতে হবে। দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বানের আগে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করে এসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদ-নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পাউবো এবং বিআইডব্লিউকে নির্দেশনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে অনুমোদিত নদী খনন প্রকল্পগুলোর ড্রেজার ক্রয় সংক্রান্ত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন। কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে প্রবহমান নদী রক্ষা আন্দোলনের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহন আহমদ এবং মাতামুহুরী-সাঙ্গু নদী রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক শরীফুল ইসলাম ড্রেজার ক্রয়ে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনেন এবং অনিয়ম, সনদ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে ৬ দফা দাবি জানান। একই সঙ্গে ড্রেজার ক্রয়ে দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। উল্টো সম্প্রতি ১২টি ড্রেজার ক্রয়ে যেসব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে তাতে ওই সিন্ডিকেটের একটি কোম্পানি ছাড়া আর কেউ অংশ নিতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, ক্রয় চুক্তি লঙ্ঘন করে একটি দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দেয়া নকল ও নিম্নমানের যন্ত্রাংশের কারণে পাউবোর সাড়ে ৪শ’ কোটি টাকার ৭টি ড্রেজার বিকল হয়ে পড়েছিল দীর্ঘদিন। এতে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প গড়াই নদী পুনরুদ্ধারসহ একাধিক নদী ড্রেজিং প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছিল। জানা গেছে, চুক্তির শর্ত মোতাবেক উন্নত দেশের তৈরি ওয়্যারিং প্লেট, ইমপিলার ও অন্যান্য অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ দেয়ার কথা। কিন্তু সেটা না করে দেশে তৈরি নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দেয়া হয় এসব ড্রেজারে। এতে একটি প্রকল্পেই জনগণের করের অন্তত ৫৫ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার পাশাপাশি শত শত কোটি টাকার প্রকল্পও হুমকির মুখে পড়েছিল। অভিযোগ আছে, ওই ড্রেজারের প্রাণশক্তি ড্রেজ পাম্পের মূল ওয়্যারিং প্লেট অন্তত ২ হাজার ৮০০ ঘণ্টা চলার পর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অথচ ঠিকাদারের দেয়া ওয়্যারিং প্লেট মাত্র ২২৫ ঘণ্টা চলেই নষ্ট হয়ে যায়। একইভাবে হোসপাইপসহ অন্য যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে। এমনকি নিম্নমানের ওয়্যারিং প্লেটের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য জোড়া-ঝালাই দেয়ার মতো জালিয়াতির আশ্রয়ও নেয়া হয়েছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে দেশীয় যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি জড়িত ছিল সেই প্রতিষ্ঠানই যাতে ২৬৮ কোটি টাকায় ১২টি ড্রেজার ক্রয়ের কাজ পায় সে জন্য বর্তমান দরপত্রে বেশকিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পিডি শহীদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আগে বেশকিছু ড্রেজার সাপ্লাইয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় এবার দেশীয় কোনো কোম্পানি যাতে মূল বিডার হিসেবে দরপত্রে অংশ নিতে না পারে সে জন্য ২০ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। তবে অনেকে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। সিঙ্গেল টেন্ডারের পরিমাণ ২১৫ কোটি অর্থাৎ বর্তমান দরপত্রের বেলায় মোট কাজের ৮০ ভাগ করার বিষয়টি সরকারি ক্রয় নীতিমালার আলোকে করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় দফায় আহ্বান করা দরপত্রে দেশীয় কোনো কোম্পানি এককভাবে অংশ নিতে পারবে না। তবে বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশীয় কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে দরপত্রে অংশ নিতে পারবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/22343/