২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:১৬

শাস্তি না হওয়ায় বিপর্যস্ত ব্যাংকিং খাত

সংকট উত্তরণে সংস্কারের বিলম্বিত উদ্যোগ মন্ত্রণালয়ের * ২৭ দফা সুপারিশসহ খসড়া চূড়ান্ত * বাস্তবায়িত হবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

অর্থ পাচারসহ চার কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, ব্যাংকের মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি। একই কারণে শ্রেণীকৃত ঋণ আদায়ের হারও কমছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। খেলাপিরা টাকা নিয়ে যাওয়ায় সরকার গত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন জোগান দিয়েছে। তাতেও কাক্সিক্ষত মাত্রায় ঘাটতি কমেনি। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ঋণের টাকায় এলসি খুলে ওভার ইনভয়েসিং করে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এতে ঋণ পরিশোধে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হওয়ায় খেলাপির তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেও বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। প্রভাবের কারণে এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে ঋণখেলাপি এবং এ খাতের কতিপয় অসাধু নীতিনির্ধারকের ভূমিকা এবং সরকারের যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ব্যাংকিং খাত সংকটের মুখে পড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকিং খাতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই তা প্রমাণিত হয়েছে বলে মত দেন বিশ্লেষকরা।
ঘনীভূত সংকট দূর করতে ব্যাংকিং খাতকে সংস্কারের আওতায় আনা হচ্ছে। মূলত এ খাতের দুর্নীতি ও জালিয়াতি বন্ধেই এ উদ্যোগ। এ লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এখাতে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় প্রথমবারের মতো অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ব্যাংক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ২৭ দফা সুপারিশের খসড়া চূড়ান্ত। সুপারিশগুলো অর্থমন্ত্রী অনুমোদন দেয়ার পরই নীতিমালা প্রণয়ন-সংশোধন ও বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। এর পাশাপাশি মূলধন ঘাটতি পূরণে বিকল্প হিসেবে ব্যাংকগুলো থেকে আইপিও ইস্যুর সুপারিশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশিস চক্রবর্ত্তী মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণের এ অবস্থা একদিনে হয়নি। এর সমাধানও একদিনে করা যাবে না। এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। খেলাপি ঋণসহ ব্যাংকিং খাতের সংকট সমাধানে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি সর্বোচ্চ ব্যক্তি। এর বেশী তিনি আর কিছু বলতে রাজী হননি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোর ভালো-মন্দ দেখার আইনি ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম মনিটর করাসহ সবকিছু তাদেরই দেখার কথা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ শুধু নীতি প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজগুলো করে থাকে। বিদ্যমান সংকটের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোই দায়ী। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলধন ঘাটতির বড় কারণ হচ্ছে খেলাপি ঋণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জানা গেছে, খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি এবং খেলাপি আদায়ের হার কম হওয়াকে ব্যাংকিং খাতের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগের প্রতিবেদনে এ চ্যালেঞ্জের কথা ওঠে আসে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে কোনো দিন এসব সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ যে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত সম্পন্ন হতে বিলম্ব হয়। আবার তদন্ত শেষ হলেও অনেক সময় দায়ীদের কোনো শাস্তি হয় না। গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতের নানা কেলেঙ্কারিতে কোনো দৃশ্যমান শাস্তি হয়নি। তিনি মনে করেন, ব্যাংকিং খাতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সততা না থাকলে খেলাপি ঋণ কাক্সিক্ষত মাত্রায় নামিয়ে আনা যাবে না। এছাড়া ঋণ আদায়, অবলোপন, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতির মতো সংকট দূর হবে না। বিশেষ করে পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংকারদের সৎ হতে হবে।
সোমবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত এ ১০ বছরে সরকার ১০ হাজার ২৭২ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে। সূত্র জানায়,বর্তমান ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমান হচ্ছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ১৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অর্থ পাচার। এলসি বা ঋণপত্র খোলার মাধ্যমে ওভার ইনভয়েসিং করে বিদেশে বিপুল অংকের অর্থ পাচার করা হচ্ছে। এটি থামাতে পারছে না সরকার। এ অর্থ পাচার বন্ধ করতে না পারলে খেলাপির লাগাম টানা সম্ভব হবে না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে যে রোগ হয়েছে তা সারানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বিরোধিতার পরও দেয়া হল। সে ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটির অবস্থা খুবই নাজুক। এরপরও আবার নতুন ব্যাংক দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় খেলাপি, অবলোপন, প্রভিশন ঘাটতি এবং মূলধন ঘাটতির কথা যতই বলা হোক ব্যাংকিং খাত ভালো হবে না। কারণ সংকটগুলো সমাধানের বাস্তবভিত্তিক কোনো উদ্যোগ নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতের সংকট উত্তরণে দুর্নীতি ও জালিয়াতি বন্ধসহ বড় ধরনের সংস্কার আনা হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ সংস্কারের কাজ করছে। সংস্কারের আওতায় বিদ্যমান নীতি ও প্রবিধিমালা নতুন করে প্রণয়ন ও সংশোধনের কর্মসূচি রয়েছে। সংস্কারের আওতায় ব্যাংকিং খাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২৭ দফা সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়। সুপারিশগুলো অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন-সংশোধন ও বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে।
জানা গেছে, সুপারিশের মধ্যে খেলাপিদের তালিকা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ, নতুন ঋণ অনুমোদন নীতিমালা সংশোধন ও জামানত গ্রহণে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়। এছাড়া নতুন ব্যাংকের শাখা খোলাকে নিরুৎসাহিত করে বিকল্প হিসেবে ‘এজেন্ট’ ও ‘মোবাইল’ ব্যাংকিং সম্প্রসারণ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর ফিট অ্যান্ড প্রপার টেস্ট করতে পৃথক গাইডলাইনের কথাও বলা হয়।
স্বল্প মেয়াদি অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে বিশেষ কয়েকটি হচ্ছে- ঋণ জালিয়াতি প্রতিরোধে জামানত হিসেবে জমি ও সম্পত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার গঠন, উচ্চ আদালতে ব্যাংকের ঋণ সংশ্লিষ্ট রিট মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠন, খেলাপি ঋণ আদায়ে সফলতার জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রণোদনা ও ব্যর্থতার জন্য শাস্তির ব্যবস্থার নীতিমালা প্রণয়ন, প্রতি ৩ মাস অন্তর শাখা অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেঁধে দেয়া টার্গেট (বিভিন্ন সূচকের) মূল্যায়ন, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার ও সামাজিক কর্মসূচি কার্যক্রমের সেবাদানের জন্য ব্যাংকগুলোকে সার্ভিস চার্জ প্রদানের কথা বলা হয়।
মধ্যমেয়াদি বিশেষ কয়েকটি সুপারিশের মধ্যে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে চলতি মূলধনের অবস্থা নিশ্চিত হওয়া কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে এ সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন, জামানত হিসেবে জমির মূল্যায়নে সার্ভেয়ার বা ক্রেডিট রেটিং কোম্পানির যোগ্যতা নির্ধারণে গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। একশ’ কোটি টাকা বা এর বেশি খেলাপি ঋণ তদারকির জন্য প্রতিটি ব্যাংকে একটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি আলাদা সেল গঠনের মাধ্যমে আদায়ের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়।
পাশাপাশি ঋণগ্রহীতার তথ্য সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে সেন্ট্রাল কেওয়াইসি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়নে প্রকল্পের নগদ অর্থের প্রবাহ বিশ্লেষণ করতে হবে। ব্যাংকের এমডি এবং সিইওদের টার্গেট দেয়া ও তা মূল্যায়ন, পরিচালকদের কার্যক্রম মনিটরিং, ব্যাংক একীভূতকরণে যুগোপযোগী গাইডলাইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়।
দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে শেয়ার ছেড়ে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে ঢাকার বাইরে (একই সিসমিক জোনের বাইরে) ডাটা ডিজাস্টার রিকভারি সাইট স্থাপন করারও সুপারিশ করা হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/22349/