২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:০৩

উল্টো নীতিতে অচল ঢাকা

উল্টো নীতি অনুসরণ ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় যানজট ও জনজটে রাজধানী ঢাকা বিশ্বে অচল মহানগরী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই অচলাবস্থার কারণে বিনিয়োগে আগ্রহীদের অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে বিনিয়োগকারীদের সড়কপথে মহানগরীতে প্রবেশ করতে কখনো কখনো লেগে যাচ্ছে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। বিমানবন্দর সড়কের কুড়িল ও বনানীতে উড়াল সেতু নির্মাণের পরও যানজট থেকে রেহাই মিলছে না। 

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়েনচাই ঝ্যাং গত ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে তাঁর তেতো অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছিলেন। শাহজালাল বিমানবন্দরে নামার পর রাতে ১৪ কিলোমিটার দূরে হোটেলে পৌঁছতে তাঁর সময় লেগেছিল এক ঘণ্টা। পরদিন বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে ওয়েনচাই ঝ্যাংয়ের কণ্ঠে শোনা গেছে হতাশার এই সুর।
তীব্র এই যানজট কমাতে বিশেষজ্ঞরা ঢাকায় অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষার্থী ভর্তি, স্কুল ও অফিসে ভিন্ন সময়সূচি, ঢাকামুখিতা কমাতে গাড়িতে টোল প্রথা চালুর সুপারিশ করেছেন। অন্যদিকে, সিঙ্গাপুর ও চীনের মতো ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নেওয়ার পর তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, প্রতিদিন গড়ে ঢাকায় নিবন্ধিত হচ্ছে ৩৮০টি গাড়ি। এর মধ্যে সিংহভাগ ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল। গত সাত বছরে ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখের ওপর।
ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন ৪৪ হাজার ৫০০ জন মানুষ। ইউএন হ্যাবিটেটের তথ্যানুসারে ঘনবসতির দিক দিয়ে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের মুম্বাই, তৃতীয় স্থানে কলম্বিয়ার মেডেলিন এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ নুর-উন-নবী কালের কণ্ঠকে বলেন, সব কিছুতে ঢাকাকে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করায় মানুষ ছুটে আসছে এখানে। ফলে জনসংখ্যার এই ঘনত্ব।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, গড়ে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকাকে সব কর্মকাণ্ড, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার ভ্রান্ত নীতি, ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা কমাতে উদ্যোগের অভাব, ইন্টারসেকশন ও লেভেলক্রসিংয়ে বাধা, সড়ক বিভাজকে যেখানে-সেখানে আড়াআড়ি পারাপারের ব্যবস্থা, লেন শৃঙ্খলার অভাব, দ্বৈত সিগন্যাল (অটোমেটেড ও ম্যানুয়াল) ব্যবস্থা, বাস স্টপেজের অপর্যাপ্ততা, ভুল স্থানে বাস স্টপেজ, রাস্তার পাশে অবৈধ পার্কিং, বাজার ও নির্মাণসামগ্রী রেখে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি গাড়িজটের বড় কারণ। এ ছাড়া বছরজুড়ে বিভিন্ন সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, শহরের মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানা গড়ে তোলায় রাজধানী অচল হচ্ছে যানজটে।
সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী বিশিষ্ট গবেষক সন্তোষ কুমার রায়ের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব কারণ।
তিনি বলেন, ঢাকার প্রধান চারটি পথ আব্দুল্লাপুর-টঙ্গী-এয়ারপোর্ট-মহাখালী-ফার্মগেট-শাহবাগ-গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী, কুড়িল-বাড্ডা-রামপুরা-মালিবাগ-খিলগাঁও-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী, মহাখালী-নাবিস্কো-সাতরাস্তা-মগবাজার-রমনা থানা-কাকরাইল-বিজয়নগর-ফকিরাপুল-শাপলা চত্বর-সায়েদাবাদ ও গাবতলী-আসাদগেট-রাসেল স্কয়ার-সায়েন্স ল্যাবরেটরি-শাহবাগ-গুলিস্তান-পোস্তগোলা/ দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পথে সিগন্যালবিহীন নিরবচ্ছিন্ন যান চলাচল নিশ্চিত করা গেলে ঢাকার যানজট নিরসন সম্ভব।
এসব মূল সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের প্রবাহ ইন্টারসেকশন, লেভেলক্রসিং, রোড ট্রান্সভার্স ক্রসিংয়ে ইউ-টার্ন, রাইট-টার্ন এবং সিগন্যালের জন্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই ৭৩টি মোড়ে ইউলুপসহ ওভারপাস বা আন্ডারপাস নির্মাণ করা হলে মূল সড়কে যানবাহন সিগন্যালবিহীন চলাচল করতে পারবে।
ইউরোপ-এশিয়াসহ বিভিন্ন মহাদেশের উন্নত মহানগরগুলোতে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি। চীনের বিভিন্ন নগরীতে স্বয়ংক্রিয় লটারি পদ্ধতি চালু রয়েছে। সে দেশে ১০ বছর ধরে আবেদন করেও বহু আগ্রহী গাড়ি কিনতে পারছেন না। সিঙ্গাপুরে ব্যক্তিগত গাড়ি শূন্যের কোটায় নামাতে ১০ বছর মেয়াদি বিশেষ সনদ সংগ্রহ করার বিধান চালু করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন নগরীতে গণপরিবহনের সুবিধার জন্য বাস রুট আবাসিক এলাকার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না।
অথচ ঢাকার রাস্তায় কী পরিমাণ গাড়ি চলাচল করতে পারে তার হিসাব না কষেই ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। সহজ ব্যাংকঋণ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শৈথিল্যের কারণে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে বর্তমানে ঢাকা অচল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে ঝুঁকেছে। পরিবারে ও প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হচ্ছে একাধিক গাড়ি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশও ঋণ নিয়ে একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করছে। আর যানজটে আটকে এসবের মাসুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জোনভিত্তিক স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রথা চালু, যথেষ্ট স্কুল বাস চালু করে ব্যক্তিগত গাড়ি কমানোর নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত বছর মন্ত্রিসভায় সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের ওই খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের জন্য মোটরযান নিবন্ধনের সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারবে। রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) ব্যবহার বন্ধ করতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একইভাবে রাস্তায় গাড়ির পার্কিং চার্জ বাড়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
মূলত মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে বলেই ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে। এ অবস্থায় ঢাকার বাইরে থেকে আসা মানুষের কাছ থেকে উচ্চহারে ফি নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। এ নিয়ে তাঁর অন্যন্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে স্কুলে ভর্তি অঞ্চলভিত্তিক করা, যে এলাকায় শিক্ষার্থীরা বাস করে সেই এলাকার স্কুলে তাদের ভর্তি হওয়া, স্কুলের সময়সূচি ও অফিসের সময়সূচি উন্নত বিশ্বের মতো ভাগ ভাগ করে দেওয়া, ঢাকা মহানগরীতে প্রবেশ করার ছয়টি রাস্তায় উচ্চহারে টোল নেওয়া ইত্যাদি।
গত ১৩ জানুয়ারি রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি মাঠে উন্নয়ন মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেছেন, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য গাড়ি কেনার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে বেশি বেশি করে কর ধার্য করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/02/28/607670