ময়মনসিংহ শহরের জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের অবস্থা এখন এ রকম-
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৮

ব্রহ্মপুত্র যেন মরা খাল!

নাব্য ফেরাতে জরুরি ভিত্তিতে খনন দাবি

দেশের নদীপ্রণালির অন্যতম প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্র। এক সময়ের খরস্রোতা এই নদ এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। প্রসারিত বুকে পানির খেলা নেই, বালুচরে ঢাকা পড়েছে অতীত ঐতিহ্য। যতই বালুচর জাগছে ততই জীববৈচিত্র্য, জীবন-জীবিকার আবহমান প্রবাহ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। স্রোত হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি। বিলুপ্ত হওয়ার পথে জেলেপল্লীগুলো। সেচের পানির অভাবে নদ অববাহিকায় চাষাবাদ দুরূহ হয়ে পড়েছে। শুস্ক মৌসুমে এই মর্মর রূপের ব্রহ্মপুত্র বর্ষায় দু'কূল উপচে প্লাবিত হয়। ভাঙনে, বানে গ্রাস করে নদপাড়ের জনপদ। ফলে এই জনপদে এখন শুধুই বিপন্নতার শঙ্কা।
ব্রহ্মপুত্র কি স্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাবে? যদি তাই হয়, তাহলে নদকেন্দ্রিক প্রকৃতি ও জীবনও বিপন্ন হবে, অনেক কিছু বিলুপ্ত হবে। তবে জনপদের মানুষ বলছে, খনন করে নাব্য ফেরানো গেলেই শুধু বাঁচানো সম্ভব হবে ব্রহ্মপুত্র। নদ খননে কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনার কথা বললেও এখনও কোনো কিছুই দৃশ্যমান হয়নি। নদপারের লাখ লাখ মানুষের দাবি, দ্রুত ড্রেজিং করে গভীরতা বাড়ানো গেলে স্রোত ফিরবে নদবুকে। বণিকের জাহাজ চলবে, জেলেরা মাছ ধরবে, নদের পানি দিয়ে হাজার হাজার হেক্টর জমি আবাদ করা যাবে। বাঁচবে প্রকৃতি, বাঁচবে মানুষ।

হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের কাছে মানস সরোবরে ব্রহ্মপুত্রের জন্ম। ব্রহ্মপুত্র মানে ব্রহ্মার পুত্র। উৎপত্তিস্থল থেকে চীনের তিব্বত, ভারতের অরুণাচল ও আসাম হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর পাশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এই পুরুষ নদ। তিন দেশে সাপের মতো গতিশীল এই আন্তর্জাতিক নদ গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব বাজারে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই পাঁচ জেলায় প্রায় ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় হাজার হাজার বছর ধরে অবদান রেখে চলেছে, যা এখন বিপন্নতার মুখে ধুঁকছে। দিন দিন বিশাল বিস্তৃত মরুপ্রান্তর হয়ে উঠছে। অথচ এক সময় এই নদ ছিল মাছের অভয়ারণ্য। পণ্য পরিবহন ও মানুষের যোগাযোগের সুবিধার কারণে নদপারে গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় হাট-বাজার, বন্দর, নগর ও গঞ্জ।

কয়েক বছর আগেও ময়মনসিংহে নদতীরবর্তী প্রায় ৪০ হাজার একর জমির আবাদ হতো এই নদের পানি দিয়ে। জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধায়ও হাজার হাজার একর জমির আবাদ ছিল ব্রহ্মপুত্রের পানিনির্ভর। উর্বর পলি মাটিতে বাম্পার ফলন হতো। সে অবস্থা আজ নেই। শীতকালে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়। এর কারণ উজানে যমুনার উৎস মুখ ভরাট হয়ে যাওয়া। ফলে স্রোতহীন ব্রহ্মপুত্রের তলদেশে পলি জমতে জমতে এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো?হাম্মদ আলী জানান, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় দেশের ২৪টি নদীর ওপর একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়। বর্তমানে এর ডিটেল ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে চলমান। এ কাজ শেষ হলে অনুমোদন সাপেক্ষে অগ্রাধিকারভিত্তিতে খনন কাজ করা হবে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে ব্রহ্মপুত্রের অবস্থা খুবই নাজুক। ভয়াবহ নাব্য সংকটে মরা খালে পরিণত হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে ধানি ও সবজি জমিতে সেচ, জলপথে যাতায়াত ও জীববৈচিত্র্য। জামালপুরের মানুষের জীবনে ব্রহ্মপুত্রের অভাবনীয় প্রভাব ছিল। নদ দিয়ে চলত স্টিমার, বিভিন্ন ধরনের নৌকা। বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসীর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল এই নদ। হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরে জীবন চালাত। নাব্য সংকটে সবই আজ ইতিহাস। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরিভিত্তিতে নদ খননের দাবি জানিয়েছেন নদপারের সচেতন মহল ও পরিবেশবিদরা।

ব্রহ্মপুত্রের পারে গড়ে ওঠা প্রধান শহর, বন্দর ও হাট-বাজারের মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ, জামালপুর, ইসলামপুর, ভৈরব বাজার, উলিপুর, চিলমারী বন্দর, থানাহাট, রৌমারী, জর রাজীবপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাট, ফুলছড়ি, সাঘাটা, কাঁচকোল, ফকিরেরহাট। নদের স্রোত না থাকায় ক্রমেই বর্ধমান এসব জনপদে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে রোগ-বালাই। নদের গর্ভ পলিতে ভরে যাওয়ায় জামালপুরে ড্রেনেজ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। শহরের ময়লা-আবর্জনা নিস্কাশন প্রায় বন্ধ গেছে। কিন্তু এক সময় দূর-দূরান্ত থেকে অনেক ব্যবসায়ী নৌকা ভেড়াতেন জামালপুরে। রানীগঞ্জ ও তমালতলা ছিল বণিকদের পছন্দের জায়গা। বিদেশ থেকেও ব্যবসায়ীরা নৌকা নিয়ে আসতেন। সেই ঐতিহ্য আর নেই।

১৯৮৮ সালে প্রথমবার ব্রহ্মপুত্র খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ভাঙনের কারণে তা আর এগোয়নি। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্রের ৮০০ মিটার প্রশস্ত উৎসমুখ ১০ মিটার উঁচু হয়ে যাওয়ায় যমুনার সঙ্গে এর পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। সংশ্নিষ্টদের ধারণা, ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খনন করলে নাব্য ফিরে আসবে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের জীবন ও প্রকৃতি বিপন্নতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে। নদ ড্রেজিংয়ে সরকারের উদ্যোগের আশায় রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষ। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় ব্রহ্মপুত্র খননের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে নদ খননের পরিকল্পনা নিয়ে স্থানীয় নাগরিক সমাজের উদ্যোগে এ অঞ্চলের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। ২০১০ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ দল নদ খননের বাস্তবতা যাচাই করে দেখতে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ পরিদর্শন করে। এরপর দীর্ঘ সময় পার হলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে পরে ময়মনসিংহে আরেকটি সভায় মন্ত্রী বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদেই খননকাজ শুরু হবে, যা এখনও প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, 'পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ড্রেজিং প্রকল্প' নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার মেঘনা নদীর মোহনা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার খোলাবাড়ির চরে যমুনা নদীর মোহনা পর্যন্ত ২৭৫ কিলোমিটার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ড্রেজিং করা হবে। এ প্রকল্পে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। তবে এটি এখনও কাগজ-কলমে রয়ে গেছে। বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, শিগগিরই প্রকল্পটি একনেকে ওঠানো হবে। যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র জনপদের আবার যোগাযোগ গড়ে উঠবে।

নদপারের মানুষের দাবি, যেভাবেই হোক ব্রহ্মপুত্র খনন করে নাব্য ফিরিয়ে আনা হোক। না হলে ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাবে নদের বালুচর। ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা শত শত চর এখন স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের দখলে যাচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠছে। চর দখল নিয়ে কাইজ্জা-কোন্দল লেগেই আছে। চর নিয়ে 'জোর যার মুল্লুক তার' নৈরাজ্য চলছে। সাইনবোর্ড লাগিয়ে অবৈধভাবে দখল করা চরের জমি প্রশাসনের চোখের সামনেই বেচাকেনা চলছে। আবার বর্ষাকালে চরের মধ্যে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বসতবাড়ি ও স্থাপনা প্লাবিত হয়ে থাকে। তখন দুর্ভোগের সীমা থাকে না। স্থানীয় লোকজন মনে করে, এসবের একটিই সমাধান হতে পারে- তা হলো যত দ্রুত সম্ভব নদ খনন করা। এ জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর-গফরগাঁও সড়কের খুরশিদ মহল সেতু এলাকায় গিয়ে ব্রহ্মপুত্র চিনতে হলে ইতিহাস পড়তে হবে। ধুধু বালুচরের মধ্যে শীর্ণকায় খালের মতো প্রবাহিত হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। নাব্য হ্রাস পেতে পেতে পানির প্রবাহ সেভাবে না থাকায় বেশিরভাগ মৎস্য ও জলজসম্পদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখানকার জীববৈচিত্র্যের অবশিষ্ট যে অংশটা টিকে আছে, তা বিপন্নতায় ধুঁকছে। জেলেরা পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আর ব্রহ্মপুত্র থেকে বেরিয়ে সাপের মতো ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট নদী এখন প্রভাবশালীদের ফসলের ক্ষেতে পরিণত হয়েছে।
যারা যেভাবে পারছে, নদের অববাহিকায় দখলের প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, নদগর্ভে পানি না থাকায় চাষাবাদ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। খুরশিদ মহল সেতু এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি ফজলুর রহমান, মমতাজ মিয়া, আরজুল মিয়াসহ অনেকের সঙ্গে আলাপকালে তারা ক্ষোভ ও আক্ষেপ প্রকাশ করেন। ভরা যৌবনকালের উত্তাল ব্রহ্মপুত্র আজ স্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে গেছে। একে বাঁচাতে হলে দ্রুত ড্রেজিং করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলার সভাপতি অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী বলেন, নদের নাব্য ফিরিয়ে আনা এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি। কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সফিকুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপুত্র ড্রেজিংয়ের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ, গফরগাঁও, হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া দিয়ে প্রবাহিত নদ ড্রেজিং করা হবে। খনন শেষ হলে ব্রহ্মপুত্র আবার যৌবন ফিরে পাবে। তিনি আরও জানান, ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন থেকে সাহেবেরচর রক্ষার জন্য ১৭৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য জমা দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পেও কিছু এলাকায় ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা আছে।

তৎকালীন বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ব্রহ্মপুত্র দিয়ে নৌবহর নিয়ে হোসেনপুর এলাকা দিয়ে যাতায়াত করতেন। বহু বিদেশি জাহাজ, স্টিমার, কার্গো যাওয়া-আসা করত। সেই ঐতিহ্য হয়তো ফেরানো যাবে না। তবে নাব্য ফেরানো না গেলে ব্রহ্মপুত্র জনপদের বিপন্ন জীবন-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের অনেক উপাদানই হারিয়ে যাবে, মরুভূমিতে পরিণত হবে এই নদের বিশাল অববাহিকা। ব্রহ্মপুত্র নদবিধৌত জনপদের মানুষ বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই নদগর্ভে খননকাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে।

http://samakal.com/bangladesh/article/18021296