২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:১৫

নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে উদ্বেগজনক হারে

২০১৭ সালের বনানীর হোটেল দ্য রেইনট্রিতে জন্মদিনের পার্টিতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। ওই বছর ২৮ মার্চ ঘটনা ঘটলেও অভিযুক্ত প্রভাবশালী হওয়ায় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতায় তা প্রকাশ পায় অন্তত দেড় মাস পর। ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে ছোঁয়া পরিবহনে শ্রমিকদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন ঢাকার আইডিয়াল 'ল' কলেজের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপা। পরে রূপার ঘাড় মটকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে রেখে যায় ধর্ষকরা। শুধু তাই নয়, ১০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে ঘটে আরেক লোমহর্ষক ঘটনা। শিশু মেয়ের ধর্ষণের বিচার না পেয়ে প্রায় দুই মাস পরে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের তলে ঝাঁপিয়ে জীবন দেন বাবা- মেয়ে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা বলছে, ২০১৭ সালে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৯৫ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে শিশুই ৩০০। নারী ৩২০ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৭ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৮ জনকে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দ্বি-গুণ বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৪০৭ জন নারী ও কন্যাশিশু। শুধু শিশু বা তরুণী নয়, বাদ পড়ছে না প্রতিবন্ধীও। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা জানিয়েছে, জানুয়ারিতে কুমিল্লায় চিকিৎসা সেবা নিতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় এক প্রতিবন্ধী নারী। তবে ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছিল, ২০১৭ সালের প্রথম ১০ মাসে ৮৩৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১৯৩টি। ওই সংস্থাটি মনে করে, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের অভাব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন নারী নির্যাতন বাড়ার পেছনে দায়ী।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, দৈনিক জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনার উপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালের, গবেষণা সেলের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, শিশু হত্যা ও নারী নির্যাতন ছিল পুরো বছর জুড়েই। তুলনামূলকভাবে বেড়েছে ধর্ষণ ও শিশু হত্যা। পারিবারিক কোন্দলে আহত ও নিহতের সংখ্যাও এই বছর তুলনামূলক বেশি। নারী নির্যাতন, আত্মহত্যা পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো গত বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। তা জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা ও অন্যান্য সহিংসতায় ঘটনায় মোট ২৪ হাজার ৬১৬ জন আহত ও ৬ হাজার ৬০২ জন নিহত হয়েছেন। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৭ সালেই শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয় ৩৫২ জন শিশু। এদের মধ্যে বাবা-মার হাতে নিহত হয় ৪২ জন শিশু।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে শিশু হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭ জন। ২০১৭ সালে নির্যাতনের শিকার হয় ২১১ জন শিশু। ২০১৬ সালে হয়েছিল ১৯৯ জন। ২০১৭ সালে যৌতুকের বলি হয়েছেন ৬০ জন নারী। যৌতুকের কারণে আহত হয় ৬২ জন নারী। পারিবারিক কলহে নিহত হয় ৪০৭ জন ও আহত হয় ১২০ জন। নিহতদের মধ্যে ২৯৩ জন নারী। সারাদেশে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত ৮৯৭ জন ও আহত হয় ৫৯২ জন। ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয় ১৪৯ জনের, এর মধ্যে পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয় ১০৭ জন, র্যা ব কর্তৃক ৩৯ জন ও অন্যান্য বাহিনী কর্তৃক ৯ জন। পুলিশ ও জেল হেফাজতে মৃত্যু হয় ৪৬ জনের। আত্মহত্যা করেছে মোট ৬৫৩ জন। এদের মধ্যে ১৯৪ জন পুরুষ ও ৪১৭ জন নারী ও ৪২ জন শিশু রয়েছে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, প্রলম্বিত বিচার পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এই সবকিছু মিলেই দেশের আপামর জনসাধারণের মানসিক ও মানবিক চিন্তা চেতনার অবক্ষয়ের কারণে বেড়ে গেছে সামাজিক অসন্তোষ। আর অসন্তোষের শিকার হয়ে এ বছর নিহত হয়েছেন ১৭১ জন, আহত হয়েছে ৫৭৮১ জন। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত হয়েছেন ২ হাজার ১৭৭ জন ও নিহত হয়েছেন ৩৩ জন।
গেল বছর মাদকের প্রভাবে বিভিন্ন ভাবে আহত হয়েছে ৮৪ জন ও নিহতের সংখ্যা ৫৫ জন। এসিড নিক্ষেপের শিকার হয় ৩৭ জন। এ বছর চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। নিখোঁজ ১১৭ জন। গণপিটুনিতে মৃত্যু হয় ৫১ জনের, আহত হয় ৬৬ জন। চলতি বছর গণগ্রেফতার হয়েছে ৫ হাজার ৬৩১ জনেরও বেশি।

http://www.dailysangram.com/post/320642