২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১১:১৬

ব্যাংকিং খাতের জন্য ইনকোয়ারি কমিশন গঠন জরুরি

কিছু ব্যাংকের মালিক ও রাজনৈতিক লোকজন ব্যাংকের মূলধন খেয়ে ফেলেছে -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

যেসব সমস্যা ব্যাংকিং খাতকে খেয়ে ফেলছে তা নিরসনে একটি ‘ইনকোয়ারি কমিশন’ গঠন করা জরুরি। কারণ রোগ লুকিয়ে রাখা যায় না। এটি প্রকাশ হবেই। এ ক্ষেত্রে সুচিকিৎসার বিকল্প নেই। রোববার বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে ১৯টি গবেষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা। এছাড়া ৭টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন তারা। বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ দুটি সেশনের সঞ্চালক ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএ চৌধুরী একটি সেশনের সঞ্চালক দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিআইবিএমের মোট ১৯টি গবেষাণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এসব গবেষণার ওপর আলোচনায় অংশ নেন ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরফান আলী, প্রাইম ব্যাংকের সাবেক এমডি আহমেদ কামাল খান চৌধুরী, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হয়নি, সম্ভবত হবেও না। এখন অন্তত একটি ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করা যায় কি-না তা ভেবে দেখা যেতে পারে, যার মাধ্যমে সমস্যাগুলো দূর করা যেত। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সবার জানা। প্রধান সমস্যা সুশাসনের ঘাটতি, সততা নেই। কিছু ব্যাংকের মালিক, রাজনৈতিক লোকজন ব্যাংকের মূলধন খেয়ে ফেলেছে। তা না হলে মূলধন ঘাটতি হতো না। তিনি বলেন, রোগ লুকিয়ে লাভ নেই। এটি বের হবেই। তাই রোগ না লুকিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
এসএ চৌধুরী বলেন, ৭টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি। প্রায় সব ব্যাংক সরকারি। এটা উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, ১৯৭২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬১ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। সরকারি ব্যাংকের বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকে ১৬ হাজার লোক নেই। প্রতি বছর ১ হাজার ৮৯০ জন অবসরে যাচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় দক্ষ জনবল নিয়োগ হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিপুল অংকের অর্থ সরকারের কাছে আটকে আছে। শুধু সোনালী ব্যাংকেরই আটকে আছে ৯ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ ফেরত দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান খোলার পরামর্শ দেন তিনি।
হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া গৃহঋণ দেয়া যাবে না। পরিচালনা পর্ষদের চাপে অনেক সময় টপ ম্যানেজমেন্ট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়। সে কারণে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংক বিপদে আছে। মূলত এটি করা হচ্ছে উপরের চাপে। তিনি বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিং প্রসারের পাশাপাশি ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। এটা কমিয়ে আনার সর্বাÍক চেষ্টা করতে হবে। বিদেশি ঋণে খেলাপি অনেক বেড়ে গেছে, যা নতুন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আউটলেট এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শাখা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইয়াছিন আলি বলেন, এক ব্যাংকের ঋণ অন্য ব্যাংকের কেনার প্রথা বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না। এটি মূলত নতুন ৯ ব্যাংক বেশি করেছে। তিনি বলেন, গৃহঋণ খুবই লাভজনক। এটি জিডিপিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলো ভাবতে পারে।
আরফান আলী বলেন, দীর্ঘমেয়াদি গৃহঋণ বেড়ে গেলে ঝুঁকি বাড়বে। তিনি বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজে কৃষি ঋণ বিতরণ করা যাচ্ছে।

আহমেদ কামাল খান চৌধুরী বলেন, অবৈধ পথে টাকা আসা বা হুন্ডির কেন্দ্রবিন্দু বিকাশ। যদিও ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করে আসছে, কিন্তু আজ তা প্রমাণিত। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ ব্যাংক মূলধন সংকটে আছে। মূলধন সংকট থাকলে একীভূত করা সম্ভব নয়।
এছাড়া অন্য বক্তারা বলেন, ব্যাংকের মালিকরা একীভূত চায় না। কারণ অনেক সরাসরি এবং গোপন সুযোগ-সুবিধা পায়। একীভূত হলে সে সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া তাদের ধারণা যত দুর্নীতি-লুটপাট হোক, যত অর্থশূন্যই হোক, তাতে ব্যাংক কোনোদিন বন্ধ হবে না। কারণ ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের। সে কারণে তারা একীভূত হতে চাইছে না। তারা বলেন, গত কয়েক বছরে বিপুল অংকের অর্থ মূলধন ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে। এসব অর্থ সবই জনগণের। এভাবে আর কত চলবে, প্রশ্ন তাদের।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/21595