২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১১:১৩

২৬ সিসি ক্যামেরা অকেজো করে ঠিকাদারকে হত্যা

৯টি বুলেটে ক্ষতবিক্ষত শরীর

দুই বছর ধরে পুরো এলাকা ২৬টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যেই একজন ঠিকাদারকে গুলি করে হত্যার পর পালিয়ে গেল খুনিরা। কারা করল এ হত্যাকাণ্ড- শুরু হল খোঁজ। সবার ভাবনা, ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় নিশ্চয়ই ধরা পড়েছে পুরো ঘটনা। গোয়েন্দারাও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, ২৬টি ক্যামেরার সবই অকেজো। কোনো ক্যামেরাই কাজ করছে না।
রোববার সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর মহাখালীর দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদ গলিতে ঠিকাদার নাসির কাজীকে (৪৫) গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি ওই মসজিদের টাইলস লাগানোর কাজের ঠিকাদারি করছিলেন। ওই কাজের তদারকি করতে ভোরে মসজিদে আসেন তিনি। কী কারণে, কারা তাকে হত্যা করেছে- এ ব্যাপারে রাত ১০টা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ঠিকাদারকে হত্যার দেড় ঘণ্টা আগে খুনিরা চারটি কোর পয়েন্ট ভেঙে ফেলে। এমনকি যে গলিতে তাকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে তিনটি সিসি ক্যামেরা ছিল। ওই তিনটি ক্যামেরার তারও ছিঁড়ে ফেলা হয়।

পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা বলছেন, ঘাতকরা প্রশিক্ষত এবং অস্ত্রচালনায় পারদর্শী। তারা ভাড়াটে খুনিও হতে পারে। নাসিরের হাতে, বুকে, পিঠে ও পেটে ৯টি গুলি লেগেছে। স্থানীয়রা ৮টি গুলির শব্দ শুনেছেন। তবে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। ঘটনা তদন্তে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একাধিক টিম এবং র্যা বের গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছেন।

নাসিরের পরিবারের ধারণা, গ্রামের বাড়ির বিরোধ এবং ঢাকায় ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে তাকে হত্যা করা হতে পারে। নাসির গুলশানের নিকেতন এবং বনানীর মহাখালী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে টাইলসের ঠিকাদারি কাজ করেন। এ নিয়ে স্থানীয় কারও সঙ্গে তার বিরোধ থাকতে পারে। এর বাইরে গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হত্যা মামলার আসামি ছিলেন নাসির কাজী। এ ঘটনার সঙ্গে ওই চেয়ারম্যানের পরিবার জড়িত থাকতে পারে বলে নাসিরের পরিবারের ধারণা।
গোয়েন্দারা বলছেন, দীর্ঘ পরিকল্পনা এবং পুরো এলাকা খুনিরা আগে থেকেই রেকি করে। পুরো এলাকার সিসি ক্যামেরা কীভাবে বন্ধ করা যায়, তার পরিকল্পনাও হয় অনেক সময় নিয়ে। খুনের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা পুরো এলাকার কোথায় কী আছে তা জানে। এমনকি যারা সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের বিষয়ে সব তথ্য আছে খুনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের। এর সঙ্গে স্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনা তদন্তে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। আশা করছি, শিগগিরই খুনিদের ধরা সম্ভব হবে।

স্থানীয়রা বলছেন, পুরো এলাকার সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত হয় সময় এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ক্যাবল নেটওয়ার্কিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সময় এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার সুমন সরদার যুগান্তরকে বলেন, ঘটনাটি ঘটেছে সকাল ৭টা ৫০ থেকে ৮টা ১০ মিনিটের মধ্যে। এর আগে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ইন্টারনেট ও সিসি ক্যামেরার লাইনটি অকেজো করে দেয়া হয়। অপটিকেল ফাইবার লাইনের কোর থাকে। একটি বোতলের মধ্যে এ কোরগুলো রাখা হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে চারটি কোর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফলে পুরো এলাকার সিসি ক্যামেরা এবং ব্রডব্র্যান্ডের ইন্টারনেট লাইন বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, মসজিদের দক্ষিণ পাশে ছোট্ট একটি গলি। ওই গলিতেই নাসির কাজীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গলিতে তিনটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। ছোট্ট গলি থেকে তিনদিক থেকে বের হওয়া যায়। তবে খুনিরা যেদিক থেকেই বের হোক না কেন, গলির মুখের সিসি ক্যামেরায় তা ধরা পড়বে। কিন্তু ওই ক্যামেরাটিও অকেজো থাকায় ঘটনাটি ধরা পড়েনি।

রোববার দুপুরে সময় এন্টারপ্রাইজের সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত একজন ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে একটি কোর পয়েন্টে কাজ করছিলেন। তিনি এই প্রতিবেদককে সেটি দেখিয়ে বলেন, এটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সবকিছুই জানেন। আমাদের বিষয়েও খুনিদের কাছে তথ্য আছে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর (উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড) মো. নাছির যুগান্তরকে বলেন, দুই বছর ধরে পুরো এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসিয়েছি। এর আগে একজন ঠিকাদারকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল। পুরো ঘটনা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ফুটেজ দেখে দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ঠিকাদার নাসিরকে যারা হত্যা করেছে, তারা সিসি ক্যামেরার বিষয়ে জানে। তারা সব সিসি ক্যামেরা অকেজো করে কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেছে। আমরা এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পড়েছি। মহাখালী দক্ষিণপাড়া মসজিদ কমিটির সভাপতি আমানউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ৭-৮ বছর ধরে মসজিদের টাইলস লাগানোর কাজ করছেন নাসির। নতুন করে তিন সপ্তাহ ধরে তিনি মসজিদে টাইলস লাগানোর কাজ করছেন। কাজ তদারকি করতে খুব সকালেই তিনি মসজিদে চলে আসেন। শুধু এ মসজিদ নয়, মহাখালীর বিভিন্ন মসজিদে তিনি টাইলসের ঠিকাদারির কাজ করেছেন।

দুটি কারণ বলছে পরিবার : নাসিরের স্ত্রী সেলিনা কাজী যুগান্তরকে বলেন, দক্ষিণপাড়া মসজিদের সভাপতি নাসিরকে অনেক পছন্দ করতেন। এ কারণে তিনি তাকে দীর্ঘদিন ধরে ঠিকাদারির কাজ দিচ্ছেন। এ নিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষের সঙ্গে তার বিরোধ ছিল। এ বিষয়ে সভাপতি সব জানেন। নাসির তাকে সব বলতেন। নাসির গুলশানের নিকেতন এবং মহাখালী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ঠিকাদারি কাজ করছেন। এ নিয়ে কারও কারও সঙ্গে তার বিরোধ থাকতে পারে।
এ বিষয়ে মসজিদের সভাপতি আমানউল্লাহ যুগান্তরকে জানান, নাসিরের সঙ্গে কারও বিরোধ আছে বা তার কাছে কেউ চাঁদা চেয়েছে- এমন কোনো ঘটনা তার জানা নেই। এ বিষয়ে নাসির তাকে কিছু বলেননি।
এদিকে নাসিরের ভাই মামুন কাজী যুগান্তরকে বলেন, ২০০৪ সালে শরীয়তপুরের একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএম খালেক রাজধানীতে খুন হন। ওই ঘটনায় নাসিরকে ১০ নম্বর আসামি করে হত্যা মামলা করে খালেকের পরিবার। ওই সময় নাসির দেড় বছর কারাগারে ছিলেন। পরে নাসিরকে এক নম্বর আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। এ নিয়ে খালেকের পরিবারের সঙ্গে নাসিরের বিরোধ ছিল। খালেকের পরিবার এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

তিনি আরও জানান, নাসির পরিবার নিয়ে উত্তরায় থাকেন। মহাখালী এলাকায় কাজ থাকলে মহাখালীর ওয়্যারলেসে তার শ্বশুড়বাড়িতে থাকেন। শনিবার রাতে তিনি শ্বশুরবাড়িতেই ছিলেন। সকালে কে বা কারা তাকে ফোন করে ডেকে নেয়।
পরিবার জানায়, নাসির দক্ষিণখান থানা এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। তার বড় মেয়ে নিপু কাজী একটি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ছেলে দীপু কাজী নবাব হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট এলাকায়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/21586