২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১১:১২

শত শত রোহিঙ্গা এখনো আসছে

শূন্যরেখা থেকে পালিয়েছেন ২ হাজার ; ‘রাখাইনের পরিস্থিতি ইতিবাচক নয়’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রæপের কাজ শুরু হলেও রাখাইনে থেমে নেই রোহিঙ্গা নিপীড়ন। আটক, হুমকি, লুটপাট, গ্রাম অবরোধ, অভিবাসন কার্ড (এনভিসি) নেয়ার জন্য জোর খাটানোসহ নানাবিধ অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ভয়ার্ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। রোববার সকালেও টেকনাফের নাফনদী পাড়ি দিয়ে মগপাড়া দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৪৪টি রোহিঙ্গা পরিবারের ১৪৪ জন সদস্য। এসব রোহিঙ্গার অভিযোগÑ মিয়ানমারের বর্বর সেনাপ্রশাসন ও মগ সন্ত্রাসীরা তাদেরকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করছে।
টেকনাফ উপজেলা প্রশাসন জানায়, মিয়ানমারে গৃহবন্দী করে রাখা, খাদ্য সঙ্কট ও নির্যাতনের কারণে রোববার সকালে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফের মগ পাড়ার বেড়িবাঁধ এলাকায় ঢুকে পড়ে ১৪৪ জন রোহিঙ্গা। পরে তাদেরকে টেকনাফের সাবরাং এ সেনাবাহিনীর হারবার পয়েন্টের ত্রাণকেন্দ্রে আনা হয়। এরপর তাদের মানবিক সহায়তা ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে পাঠানো হয়েছে। গত তিন দিনে টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।
এসব রোহিঙ্গা স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, মিয়ানমারের সেনাদের আচরণ, ব্যবহার ও তাদের হিংসাত্মক মনোভাব এখনও অপরিবর্তিত। তাদের বাড়ি থেকে বের হতে না দেয়া ও হাটবাজারে যাওয়া-আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় তারা ঘর থেকে বাইরে যেতে পারছেন না। এতে করে অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েদের কান্না সইতে না পেরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
গত শনিবার সকালে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আসা ৭০ বছরের নূরবানু টেকনাফের সাবরাং হারিয়াখালী ত্রাণকেন্দ্রে এসে পৌঁছেন। তার বাড়ি রাখাইনের বুচিডংয়ের কুইন্যাপাড়া গ্রামে। নূরবানু জানান, রাতের আঁধারে নাফ নদী পেরিয়ে নৌকায় ৩০ জনের মতো এপারে ঢোকেন। এরপর হেঁটে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে ত্রাণকেন্দ্রে পৌঁছেন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কী অবস্থা জানতে চাইলে নূরবানু বলেন, খাদ্যের সংস্থান না হলে ইচ্ছা করলেও তাদের থাকার কোনো উপায় নেই। তাই সেখানে থাকা আসলে মৃত্যুর সমান।
এ দিকে আগামী মাসের (মার্চ) মাঝামাঝি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম শুরু করার কথা বলছে মিয়ানমার। কিন্তু রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় স্বদেশে ফিরতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করেনি মিয়ানমার সরকার। উপরন্তু রোহিঙ্গাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও স্থাপনাগুলো বুলডোজার দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করছে না সরকার।

রোহিঙ্গারা শরণার্থী, অভিবাসী নাকি নাগরিক হিসেবে মিয়ানমারে ফিরবে তা নিশ্চিত নয়। সঙ্কট শুরুর ছয় মাস পর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আলোচনা যখন চলছে, তখনো আশ্রয়ের খোঁজে রোহিঙ্গারা আসছে বাংলাদেশে। টেকনাফ উপজেলা সীমান্ত দিয়ে এখনও প্রতিদিনই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে দুই থেকে ৩০০ রোহিঙ্গা। অবরুদ্ধ অবস্থায় খাদ্যসঙ্কটের সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের নির্যাতনই তাদের বাংলাদেশে চলে আসার কারণ।
এ দিকে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ভয়ে সীমান্তের তুমব্রæ কোনারপাড়া শূন্যরেখা থেকে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছে। তারা কোথায় গেছে তা সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গারা নিশ্চিত নন। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের ফলে রোহিঙ্গারা এ দেশে পালিয়ে আসার ধারাবাহিকতায় প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা তুমব্রæ শূন্যরেখায় অবস্থান নেন। এসব রোহিঙ্গাকে খাদ্য, ওষুধপত্রসহ যাবতীয় ত্রাণসামগ্রী বিভিন্ন এনজিও নিয়মিত দিয়ে আসলেও শূন্যরেখায় এপারে যেন আসতে না পারে সে ব্যাপারে বিজিবির কঠোর দিকনির্দেশনা ছিল বলে জানা গেছে।
গত ২০ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রæপের প্রতিনিধিদল শূন্যরেখা পরিদর্শন করে সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকার ও পরিবারভিত্তিক তালিকা করার নির্দেশ দিলে রোহিঙ্গাদের ভীতির সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে দুই হাজার রোহিঙ্গা হঠাৎ করে রাতের আঁধারে শূন্যরেখা ত্যাগ করার ঘটনা নিয়ে প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শফিউল আলম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হোসেন ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: এস এম সরওয়ার কামাল তুমব্রæ কোনারপাড়া শূন্যরেখা রোহিঙ্গা বস্তি পরিদর্শন করে দুই হাজার রোহিঙ্গা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিশ্চিত হন। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদে স্থানীয় বিজিবি, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে মতবিনিময় করে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দ্রæত সময়ের মধ্যে ফেরত নেবে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধানেরও ব্যবস্থা নিয়েছে। তাই সেখান থেকে রোহিঙ্গারা যাতে পালাতে না পারে সে দিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। শূন্যরেখা থেকে যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছে তাদের খুঁজে বের করে বিজিবি ও পুলিশের হাতে সোপর্দ করার পরামর্শ দেন তিনি। এ সময় ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ, সাবেক চেয়ারম্যান খাইরুল বাশার, ঘুমধুম ফাঁড়ির ইনচার্জ (ওসি তদন্ত) ইমন ও আইভি রহমান স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি ছৈয়দুল বশর উপস্থিত ছিলেন।
আইএসসিজির সংবাদ সম্মেলন
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রæপের কাজ শুরু হলেও রাখাইনের পরিস্থিতি এখনো ইতিবাচক নয়। তাই সেখান থেকে এখনো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের ছয় মাস অতিক্রম উপলক্ষে এই সঙ্কটে গঠিত ইন্টারসেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রæপের (আইএসসিজি) সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়ে এখনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে দুঃখজনক বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও সহায়তার আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়ার কথা জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক মহিলা গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং অনেক শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাদের মনো-সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী এক জায়গায় গাদাগাদি করে থাকায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির আশঙ্কাও বাড়ছে। এ ছাড়া আগামী বর্ষা মওসুমকে রোহিঙ্গাদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/297047