২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১১:০৭

একাদশ সংসদ নির্বাচন : সম্ভাবনা ও আশংকা প্রসঙ্গ

আশিকুল হামিদ : চাল-ডাল-তেল ও সবজিসহ পণ্যের বেড়ে চলা দামের এবং মানুষের নাভিশ্বাস ওঠা সম্পর্কে কোনো আশার কথা নেই, ওদিকে শুরু হয়ে গেছে একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য দৌড়ঝাঁপ। এ ব্যাপারে যথারীতি সূচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী সিলেটে হজরত শাহ জালাল (রহ:) ও হজরত শাহ পরাণ (রহ:)-সহ তিন অলি আল্লাহর মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। গেছেন বরিশাল এবং রাজশাহীতে। নৌকার জন্য ভোট চেয়েছেন। কথিত উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যে আরো একবার নৌকায় ভোট দিয়ে তাকে সরকার গঠন করতে দেয়ার আহবান জানিয়েছেন। ওদিকে নির্বাচনের দৌড়ে অংশ নিতে এগিয়ে এসেছেন সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিও প্রধানমন্ত্রীর পরপর একই সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। তিনশ’ আসনে প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা তো দিয়েছেনই, জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় যাবে বলে দৃঢ় আশাও ব্যক্ত করেছেন।
ভোটের দৌড় শুরু করার ব্যাপারে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটাতে হয়েছে বেগম খালেদা জিয়াকে। গাড়ি বহর নিয়ে সিলেট অভিমুখে অঘোষিত লং মার্চ করেছেন তিনি। কোনো সভা-সমাবেশ না করলেও এবং প্রকাশ্যে বিএনপিকে ভোট দেয়ার আহবান না জানালেও অলিদের মাজার জিয়ারত করায় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, প্রধানমন্ত্রী এবং এরশাদের মতো তিনিও আসলে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। সিলেট থেকে ফিরে আসার দু’দিনের মধ্যে দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের জন্য দন্ডিত হয়ে কারাগারে গেছেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু তারও আগে বিএনপির গঠনতন্ত্রের সাত নম্বর ধারা বাতিল করা হয়েছে। এ ধারাটির মূলকথায় বলা হয়েছিল, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এবং দন্ডিত কোনো ব্যক্তি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেন না। মামলার রায়ের ঠিক প্রাক্কালে হঠাৎ করে গঠনতন্ত্রের সাত নম্বর ধারা বাতিল করার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় বলা হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে এবং বিজয়ী হলে ক্ষমতায় যেতে পারেন তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যই রাতারাতি দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়েছে। বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকেও বোঝা যাচ্ছে, দলটি নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের পূর্বশর্ত শুধু একটিই- বেগম খালেদা জিয়াকে অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে হবে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার পাশাপাশি তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘এতিমের অর্থ চুরি’ করার অভিযোগ এনে মা ও ছেলেকে ভোটের দৌড় থেকে দূরে রাখার জন্য রীতিমতো অভিযান চালাচ্ছেন তারা। বলে বেড়াচ্ছেন, ‘এতিমের অর্থ চুরি’সহ দুর্নীতির অভিযোগ নাকি প্রমাণিত হয়ে গেছে! বিষয়টি নিয়ে যেমন, আইনের ব্যাখ্যা নিয়েও তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে উঠেছে। অর্থ চুরি ও দুর্নীতির দায়ে ‘দণ্ডিত’ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না- সে প্রশ্নে আসছে নানা রকমের ব্যাখ্যা। সাধারণভাবে একটি ব্যাখ্যা অবশ্য শক্তি অর্জন করেছে। এর মূলকথা হলো, মা ও ছেলের জন্য উচ্চ আদালত ‘সেভিয়ার’ হয়ে উঠতে পারেন। হাই কোর্ট যদি নিম্ন আদালতের রায়কে বাতিল না করে অন্তত স্থগিতও করেন তাহলেও বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তাছাড়া হাই কোর্টের পর রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেখানেও খালেদা জিয়ার জন্য সুযোগের সৃষ্টি হতে পারে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও তেমন ‘আশা’ই প্রকাশ করেছেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎশেষে বেরিয়ে এসে তিনি বলেছেন, উচ্চ আদালতে আপিল করার মাধ্যমে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন বলে তিনি আশা করেন।
এভাবে সব মিলিয়েই বিএনপিকে নিয়ে আলোচনা জমে উঠেছে। বলা হচ্ছে, মামলার পর মামলা চাপিয়ে এবং নি¤œ আদালতকে দিয়ে দন্ড দিয়েও সরকার বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে সক্ষম হবে না। ক্ষমতাসীনরা অবশ্য প্রকাশ্য বক্তব্যে বিএনপির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। তাদের আপত্তি শুধু মা ও ছেলের বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমের খবরেও বলা হয়েছে, সরকার তথা আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনে চায়, তবে ‘খালেদাকে ছাড়া’। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বশেষ উপলক্ষেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। বিএনপি একই সঙ্গে আইনি পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর ২০ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে আপিল করা হয়েছে। দন্ডাদেশসহ রায়টিকে বাতিল করার আবেদন জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। ফলে শুরু হয়েছে অপেক্ষার পালা।

খালেদা জিয়ার ভাগ্যে ঠিক কি ঘটবে সে বাপারে অবশ্য এখনো বলার সময় আসেনি। কারণ, আরো কয়েকটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে, রায়, দন্ডাদেশ এবং আপিলের চক্রে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে বিএনপির নেত্রীকে। বলা যায় না, তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে প্রার্থীই হতে পারবেন না। তেমন অবস্থায় সরকারের ইচ্ছাই পূরণ হতে পারে। বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে, তবে ‘খালেদাকে ছাড়া’! রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও সেটাই মনে করেন। কারণ, একাদশ সংসদের নির্বাচনে অংশ না নিলে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। দলটিতে এমনকি ভাঙনও ঘটতে পারে। অমন অশুভ পরিণতি এড়ানোর স্বার্থে হলেও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে বেগম খালেদা জিয়াকে কারাদন্ড দেয়ার পাশাপাশি বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে চালানো হচ্ছে গ্রেফতারের ভয়ংকর অভিযান। দ্বিতীয় প্রধান জনসমর্থিত দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নির্মূল করার অভিযানও চলছে একযোগে। তারও আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত‘র নেতৃত্বে এমনভাবেই সংবিধান সংশোধন করে রাখা হয়েছে, যাতে জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে। জামায়াতের প্রতীক দাড়িপাল্লাকেও নিষিদ্ধ করিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। এভাবে সব মিলিয়েই এমন আয়োজন এরই মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে, যাতে আওয়ামী লীগ এবং তার পার্টনার জাতীয় পার্টি ও ইনু-মেননদের খান কয়েক খুচরা দল ছাড়া আর কারো পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব না হয়। সুতরাং একাদশ সংসদের নির্বাচন এবং তার ফলাফল ঠিক কেমন হবে সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না।

প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, বিএনপির অংশ নেয়াটাই শেষ কথা নয়। একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন কেমন হবে সে ব্যাপারেও জল্পনা-কল্পনা যথেষ্টই হচ্ছে। আশংকাও কম প্রকাশ করা হচ্ছে না। এর কারণ সম্ভবত পৃথকভাবে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটাল’ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত লক্ষ্য করলেই আশংকার কারণ পরিষ্কার হয়ে উঠবে। সেবার লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ‘রোডম্যাপ’-এর পটভূমি রচনা করা হয়েছিল। সবশেষে শেখ হাসিনার ‘আন্দোলনের ফসল’ ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল মইন উ আহমেদ এবং ফখরুদ্দিন আহমদরা এমন এক নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, যে নির্বাচনে মিনিটে ১৭ জন পর্যন্ত ভোটার ভোট দিয়েছে বলে দেখানো হয়েছিল। এ ছিল এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ, নিজের ভোটার নাম্বার ও নাম-ঠিকানা জানিয়ে ও মুরি বইতে স্বাক্ষর দিয়ে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করা, আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগানো, পোলিং বুথের ভেতরে যাওয়া, পছন্দের প্রার্থীর ঘরে সিল মারা এবং ব্যালট পেপার ভাঁজ করে স্বচ্ছ বাক্সে ফেলা পর্যন্ত কাজগুলো সারতে হলে কম করে হলেও পাঁচ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগার কথা। সুতরাং প্রতি মিনিটে ১৭ জন করে ভোটারের পক্ষে ভোট দেয়া একেবারেই সম্ভব নয়। কিন্তু সে অসম্ভবকেই সম্ভব করানো হয়েছিল।

প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার ভোটের ব্যবধানও চৌর্যবৃত্তির বিষয়টিকে পরিষ্কার করেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক কোটি ৫৮ লাখ এবং বিএনপি এক কোটি ৪২ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল ১৬ লাখ ভোটের। এর পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই কোটি ২৩ লাখ এবং বিএনপি দুই কোটি ২৮ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল পাঁচ লাখ ভোটের। এটাও স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু ২০০৮-এর নির্বাচনে দুই প্রধান দলের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান দেখানো হয়েছিল এক কোটি ১১ লাখ! দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোট যেখানে বেড়েছে এক কোটি ১৯ লাখ, বিএনপির সেখানে বেড়েছিল মাত্র তিন লাখ! এত বিরাট ব্যবধান শুধু অস্বাভাবিক নয়, অগ্রহণযোগ্যও।
কিন্তু সেটাই ঘটানো হয়েছিল। ঠিক কোন দেশ এ ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছিল সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষও জেনে গেছে অনেক আগেই। আওয়ামী লীগ সরকার সে ঋণই শোধ করেছে বিগত প্রায় নয় বছর ধরে। দেশটিকে সবকিছু দিয়ে চলেছে ‘চাহিবা মাত্র’।

এরই ধারাবাহিকতায় আয়োজিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল অনেক আগে থেকে। মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকসহ সর্বোচ্চ আদালতের একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী। তাদের কেউ সরকারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ‘ত্রাণ’ নিয়েছেন, কেউ আবার প্রধান বিচারপতির চেম্বারের দরজায় লাথি মারার ‘পুরস্কার’ও পেয়েছেন। সব মিলিয়েই এ গোষ্ঠীর লোকজন সুপ্রিম কোর্টকে কলুষিত করেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সম্মানকে করেছেন ভূলুণ্ঠিত। মূলত বিচারপতি নামের ওই গোষ্ঠীকে সেবাদাসের মতো ব্যবহার করেই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে ইচ্ছামতো কাঁচি চালাতে পেরেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পাশাপাশি সংবিধানে এমনভাবেই নানা সংশোধনী আনা হয়েছিল যার ফলে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে কারো পক্ষেই নির্বাচনে জিতে আসা এবং সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না। এতকিছুর পরও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি ক্ষমতাসীনরা। সরকার তাই র্যা ব পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গুন্ডা-সন্ত্রাসীদেরও মাঠে নামিয়েছিল। গ্রেফতার ও দমন-নির্যাতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালানো হয়েছিল গুম ও হত্যার অভিযান।
একযোগে প্রতারণার কৌশলও নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। সংলাপ ও সমঝোতার আড়ালে একদিকে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করেছেন, অন্যদিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে ঠেলে দিয়েছেন নির্বাচনের বাইরে। ১৫৪ জন এমপিকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ করার রেকর্ড গড়েই থেমে যাননি তারা, একই সঙ্গে ভোট জালিয়াতিও করেছিলেন যথেচ্ছভাবে। পাঁচ থেকে সাত শতাংশের বেশি ভোট না পড়লেও দাবি করেছেন, ভোট নাকি পড়েছে ৪০ শতাংশ! ক্ষমতাসীনরা কথাটা এমনভাবে বলেছেন, যেন ওটা ৪০ নয়, ৮০ শতাংশ! অনন্দে উচ্ছ্বসিত ক্ষমতাসীনরা লক্ষ্যই করেননি যে, প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার মধ্যে আর যা-ই হোক, গর্বের কিছু থাকতে পারে না। কারণ, ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার অর্থ হলো, বাকি ৬০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোট দেননি। ক্ষমতাসীনরা নিশ্চয়ই অংকে এতটা কাঁচা নন যে ৪০ এবং ৬০-এর মধ্যকার পার্থক্যটুকু তারা বুঝতে পারবেন না।

তা সত্ত্বেও একদিকে বেগম খালেদা জিয়ার ভাষায় ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদন্ডহীন’ নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য এবং সম্ভবত সরকারেরই নির্দেশে ৩৯ দশমিক ৮৯ শতাংশের একটা হিসাব দাঁড় করিয়েছিল, অন্যদিকে লজ্জা-শরমের মুন্ডু চিবিয়ে খেয়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেরাও সে হিসাবটিকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন। জনগণকেও তারা সে কথাটাই শুনিয়ে ছেড়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাপনায় ও প্রচারণায় ঘাটতি না থাকলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এর একটি প্রমাণ পর্যবেক্ষকদের সংখ্যাস্বল্পতা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের সময় বিদেশি ৫৮৫ জনসহ পর্যবেক্ষক ছিলেন এক লাখ ৬০ হাজার। সেখানে ২০১৪ সালে বিদেশি পর্যবেক্ষক এসেছিলেন মাত্র চারজন, অন্যদিকে দেশি পর্যবেক্ষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১০ হাজার। একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক সম্ভাবনার কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট এ নির্বাচন বর্জন করেছিল এবং ভোট না দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছিল।
স্মরণ করা দরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনার মাধ্যমে সংকটের শুরু করেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করেছে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাড় দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং শেখ হাসিনা ওই সরকারের প্রধান হতে পারবেন না। জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ এবং গণচীনও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছিল। এজন্য প্রধান দুটি দলকে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছিল। অন্যদিকে সংলাপের নামে একের পর এক নাটক সাজিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করলেও তার পেছনের কূটিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। সর্বশেষ উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর প্রচেষ্টাকেও ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা।

একাদশ সংসদের নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশপ্রেমিকদের মধ্যে উদ্বেগ-আশংকা ছড়িয়ে পড়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত নির্বাচন নামের কর্মকান্ডের কারণে। ক্ষমতাসীনদের মিথ্যাচারের কারণে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলসহ বিভিন্ন ঘটনা। সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় ন্যক্কারজনকভাবে বিদায় করা হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে। তিনি এমনকি দেশেই থাকতে পারেননি। সিনিয়রিটির প্রচলিত নিয়ম লংঘন করার লক্ষ্য নিয়ে এস কে সিনহার পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী বিচারপতি আবদুল ওয়াহাবকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন ক্ষমতাসীনরা। ‘জাতির পিতা’র কবর জিয়ারত করার মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের সুনজরে পড়ার ও থাকার জন্য নতুন প্রধান বিচারপতি ছুটে গেছেন টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত। আর সেই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আবার ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কথাটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।

বর্তমান পর্যায়ে আশংকার কারণ হলো, প্রতিপক্ষ তো অভিযোগ করেছেই, ঘটনাপ্রবাহেও প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীনরা এগোচ্ছেন দেশকে একদলীয় শাসনের অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। সংবিধানের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা আসলে সেটাই নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। একই কারণে দেশে গণতন্ত্র ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। জনগণের ওপর বাকশালের মতো একদলীয় শাসন চাপানো হতে পারে বলেও আশংকার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবকিছু নীরবে ‘হজম’ করা ছাড়া কিছুই করার নেই জনগণের। কারণ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর থেকে জনগণ শুধু সরকারের ‘পতন’ ঘটানোর হুংকার শুনে এসেছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে চাল-ডাল- তেলসহ প্রতিটি পণ্যের দাম লাফিয়ে বেড়েছে। এখনো মোটা চাল পর্যন্ত ৪৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ওদিকে ‘চাহিবা মাত্র’ সবকিছু পেয়েছে ভারত। বিনিময়ে তিস্তা চুক্তি পর্যন্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু এত কিছুর পরও সরকারের বিরুদ্ধে সামান্য আন্দোলনের চেষ্টা করা হয়নি। এমন অবস্থার সুযোগ নিয়েই কথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইলামীর শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তখনও ‘টু শব্দটি’ পর্যন্ত শোনা যায়নি। প্রতিবাদ করার দায়িত্ব যাদের ছিল তারা কেবল সরকারের ‘পতন’ ঘটানোর হুংকার শুনিয়েছেন!

একই কারণে একদিকে জাতির ওপর অনির্বাচিত একটি সরকার চেপে বসার সুযোগ পেয়েছে, অন্যদিকে সে সরকারের উদ্যোগেই বর্তমানে চলছে আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য নতুন নির্বাচন আয়োজনের তৎপরতা। আমরা জানি না, এবারের নির্বাচন ঠিক কোন পন্থায় সম্পন্ন করা হবে। তবে এটুকু বলে রাখা যায়, সুযোগ পেলে ভোটার জনগণ ‘কষেই’ জবাব দেবে।

http://www.dailysangram.com/post/320493