শেষ সম্বল নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা-ফাইল ছবি
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ১১:০১

এখনও আসছে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত

রোহঙ্গিা সংকট ৬ মাস

সংকট শুরুর ছয় মাস পর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আলোচনা যখন চলছে, তখনও আশ্রয়ের খোঁজে রোহিঙ্গারা আসছে বাংলাদেশে। গত বছর আগস্টের শেষদিকে প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য আসে বাংলাদেশে। আগের মতো ব্যাপক হারে না এলেও টেকনাফ উপজেলা সীমান্ত দিয়ে এখনও প্রতিদিনই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে দুই থেকে তিনশ' রোহিঙ্গা। অবরুদ্ধ অবস্থায় খাদ্য সংকটের সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের নির্যাতনই তাদের বাংলাদেশে চলে আসার কারণ।

গতকাল শনিবার সকালে নাফ নদ পেরিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং হারিয়াখালী ত্রাণকেন্দ্রে এসে পৌঁছান নুর বানু। তার বয়স ৭০ বছর। বাড়ি মিয়ানমারের বুচিডংয়ের (বুথেডং) কুইন্যাপাড়া গ্রামে। নুর বানু জানান, রাতের আঁধারে নাফ নদ পেরিয়ে একটি নৌকায় করে ৩০ জনের মতো এপারে ঢোকেন। এরপর হেঁটে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে ত্রাণকেন্দ্রে পৌঁছান। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কী অবস্থা জানতে চাইলে নুর বানু বলেন, খাদ্যের সংস্থান না হলে ইচ্ছা করলেও তাদের থাকার কোনো উপায় নেই। তাই সেখানে থাকা আসলে মৃত্যুর সমান। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হারিয়াখালী পয়েন্ট দিয়ে ২২ পরিবারের ৮৫ জন এসেছে

টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক বলেন, প্রত্যাবাসন চুক্তির পর মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা করেনি। তাই এখনও প্রতিদিনই নৌকায় নাফ নদ পেরিয়ে এসে টেকনাফ উপজেলা সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। তাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে নয়াপাড়া শিবিরে পাঠানো হচ্ছে।

মিয়ানমারের নেপিদোতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনায় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি প্রথম দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করার কথা থাকলেও ফের ধূম্রজালে আটকা পড়ে যায়। দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের তত্ত্বাবধানে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কার্যত কিছুই হয়নি। প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি বলতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারে কিছু ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। আর রোহিঙ্গাদের নদীপথে ফেরত পাঠানোর জন্য গত সপ্তাহে টেকনাফের কেরণতলীতে প্রত্যাবাসন ঘাট নির্মাণে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা আশ্রয় শিবির ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। কারণ প্রত্যাবাসিত হলে সেখানে তাদের বসতভিটা, ক্ষেত-খামার, জায়গা-জমি কিছুই ফিরে পাবে না।

কবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে, তার কোনো দিন-তারিখ বলতে পারছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে মিয়ানমারের কাছে তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেটা তারা যাচাই করে আমাদের জানাবেন এবং তার পরই অন্যসব কাজ শুরু হবে।

প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে আছে, যারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চাইবে তাদেরই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। তবে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ত্রাণ শিবির ঘুরে শরণার্থীদের কাছে এ নিয়ে জানতে চেয়ে এমন একজনও পাওয়া যায়নি, যে মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী।

টেকনাফের লেদা প্রধান সড়কের পূর্বদিকে নতুন করে গড়ে ওঠা সারি সারি রোহিঙ্গা শিবিরের একটিতে পাঁচ মাস ধরে বসবাস করছেন জাহানারা বেগম। তার বাড়ি মংডুর হাসসুরাতা গ্রামে। তিনি বলেন, 'শীত মৌসুমে শীতে কাঁপছি, গরমকালে পুড়তে হবে, বর্ষায় ভিজতে হবে। এই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জীবন। তাও ভালো আমরা এপারে এসে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। ওপারে ভালো করে শ্বাস ফেলতেও ভয় হতো।'

টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবদুল মতলব বলেন, মিয়ানমার থেকে নিঃস্ব হয়ে প্রাণে বেঁচে বাংলাদেশে এসে পাহাড়, জঙ্গল ও খোলা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গারা। তারা তো নিজ দেশে ফিরতেই চায়। তবে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের নামে নাটক করছে। তারা কোনো দিন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না; বরং এখনও যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে রয়ে গেছে তাদের বিতাড়নের চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্তত পাঁচবার রোহিঙ্গারা এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তবে অতীতের চেয়ে এবার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা বহুগুণ বেশি। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সাংসদ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, প্রত্যাবাসন প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্যায়েও প্রতিদিনই বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফে দিন দিন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারকে আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করতে তিনি আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানান।
উখিয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় ঘাটতি নেই। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত কিছু এনজিওর কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা, পানীয় জল, চাল, ডাল ও কাপড়-চোপড় দিয়ে বাংলাদেশেই থেকে যেতে উৎসাহিত করছে তারা। যে কারণে কর্মহীন রোহিঙ্গারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

http://samakal.com/whole-country/article/18021176