২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ১০:৫৭

আইএমএফের প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে সরকার

১২ দিনের সফরে আজ আসছে প্রতিনিধি দল * ৩০টি প্রশ্নের একটি তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে

খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার বৃদ্ধিসহ ব্যাংকিং খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রশ্নে মুখে পড়তে যাচ্ছে সরকার। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ ও তা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করা হতে পারে। এক্ষেত্রে জানতে চাওয়া হবে- খেলাপি ঋণ আদায় ও তা কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ধরনের বিধিবিধানের সংস্কার করছে কিনা। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের কারণে অর্থনীতিতে প্রভাব, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনার হালনাগাদ, ভ্যাট আইন কার্যকর বিলম্বে রাজস্ব আদায়ে প্রভাব ও বাজেট বাস্তবায়নের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রসঙ্গেও জানতে চাইবে আইএমএফ।
আজ রোববার ১২ দিনের সফরে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসছে। আগামী ৮ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করার কথা। প্রতিনিধি দলটি এ সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করবে। প্রসঙ্গত, প্রতি বছর বাজেট প্রণয়নের আগে সংস্থার একটি পর্যবেক্ষণ দল ঢাকা সফরে আসে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিনিধি দলের এই সফরের আগে আইএমএফের ঢাকা অফিস থেকে বাংলাদেশে অর্থনীতির সর্বশেষ অবস্থা জানতে ৩০টি প্রশ্নের একটি তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবার প্রশ্নগুলোর জবাব তৈরি করে পাঠানোর জন্য অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। পরবর্তীকালে অর্থনীতির সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিংবিষয়ক উপদেষ্টা এসকে সুর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আইএমএফের সঙ্গে সব সময় বৈঠক হয়ে থাকে। সংস্থাটি মুদ্রানীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে। এটা নতুন কিছু নয়। রুটিনমাফিক বৈঠক।
সূত্র মতে, এবার ব্যাংকিং খাতের ওপর আইএমএফের বেশি দৃষ্টি থাকবে। সংস্থাটির প্রশ্নের তালিকায় অধিকাংশই হচ্ছে ব্যাংকিং খাত নিয়ে। গুরুত্ব পাওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে সম্প্রতি সময়ে ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ চারজন পরিচালক থাকার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা। পরিবারতন্ত্র নিয়ে অনেক আগে থেকে আইএমএফের আপত্তি ছিল।

আন্তর্জাতিক এই সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন ও খেলাপির পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ঋণ অবলোপনকৃত অর্থের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকিং খাত নিয়ে জবাব দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ সরকারের বাইরে ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। আর সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য এনবিআর ও পরিকল্পনা কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় আইএমএফের দেয়া প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, আইএমএফের প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং খাতের আমানতের অবস্থা কোন পর্যায়ে আছে, ঋণ ও আমানতের সুদ হারের সর্বশেষ অবস্থা, জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সুদের হার বেশি অফার করছে কিনা। পাশাপাশি অস্বাভাবিক হারে সঞ্চয়পত্র বিক্রির কারণে ব্যাংকিং খাতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়ছে কিনা তাও জানতে চাওয়া হতে পারে।

জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ঋণ ব্যবস্থাপনার মূলনীতিও। এছাড়া আমানতকারীরা সঞ্চয়পত্রমুখী হওয়ায় ব্যাংকগুলোর আমানত কমে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার। ইতিমধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা খাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ার প্রভাব খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ঋণ ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেই (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ হচ্ছে ২৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৬ মাসেই মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ অর্জিত হয়ে গেছে।
বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সরকার চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। আইএমএফ মনে করছে এই পদক্ষেপের ফলে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি কমছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ এবং বিনিয়োগ বাড়বে। বাস্তবে তা হচ্ছে কিনা এর অগ্রগতিও চাওয়া হবে।

সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাত ছাড়াও আইএমএফের প্রতিনিধি দল সামষ্টিক অর্থনীতির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে বৈঠক করবে অর্থ বিভাগের সঙ্গে। সেখানে চলতি বাজেটের সর্বশেষ বাস্তবায়ন হার কতটুকু অর্জন হয়েছে এবং আগামীতে কাটছাঁট করে সংশোধিত সম্ভাব্য বাজেট কত হবে তা জানতে চাইবে। একই সঙ্গে নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী বাজেটের পরিকল্পনা, এই বাজেটে সরকারের সামনে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে তাও জানতে চাওয়া হবে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
অবশ্য ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা হবে সংশোধিত বাজেটের আকার। চলতি বাজেট হচ্ছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। আর আগামী বাজেটের সম্ভাব্য আকার হচ্ছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে চলতি বাজেটে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন ঘোষণা থেকে সরকার সরে এসেছে। এতে রাজস্ব আয়ে এর প্রভাব জানতে চাইবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠকে এই প্রশ্ন ছাড়াও সরকারের করনীতি সম্পর্কে জানতে প্রশ্ন তুলবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। রাজস্ব আদায়ের সর্বশেষ অবস্থা, লক্ষ্য অর্জন সম্ভব কিনা- তাও খতিয়ে দেখবে।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব ফেলছে তা আলোচনায় নিয়ে আসবে। পাশাপাশি সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রভাব, আগের মুদ্রানীতির সঙ্গে বর্তমানের তুলনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহসহ আরো কিছু বিষয় জানতে চাইবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।
এছাড়া মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্কের অবতারণা করতে না চাইলেও আইএমএফ তাদের প্রাক্কলন কিংবা অন্য দাতা সংস্থা এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলনের বিষয়টি তুলে ধরতে পারে। তবে সরকার তাদের অবস্থান সম্পর্কে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরবে। প্রতিবারের মতো এবারও চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) কত অংশ ব্যয় ও আগামী এডিপির সম্ভাব্য আকার জানতে চাইতে পারে বলে জানা গেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/21205