২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ১০:৫৪

রোহিঙ্গা ঢলের ছয় মাস

সংকট সমাধানের উদ্যোগ দেখলেই অশান্তির ছক!

তিন দিন আগেই মিয়ানমারের একজন মন্ত্রী বলেছিলেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। এরপর গতকাল শনিবার ভোরে তিনটি বোমায় প্রকম্পিত হয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতুয়ে। মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয় গতকাল বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের তৎপরতার ছবি প্রকাশ করে বলেছে, বোমায় একজন পুলিশ সদস্য সামান্য আহত হয়েছেন।

ঢাকার কূটনীতিকদের আশঙ্কা, এ ধরনের ঘটনায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে আরো দমন-পীড়ন চালানোর সুযোগ পাবে। আর এতে রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান বা প্রত্যাবাসনে উদ্যোগ দৃশ্যমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের হামলা আসলে কারা করছে এবং আদৌ তারা এ সংকট সমাধান চায় কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে আদালত গত সপ্তাহে চারজন রোহিঙ্গাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কতজন ফিরে যেতে চাইবে তা নিয়েও সংশ্লিষ্টদের সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, আনান কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের রূপরেখা হিসেবে কাজ করছে। এর আগে এ ধরনের কোনো রূপরেখা ছিল না। গত বছরের ২৩ আগস্ট আনান কমিশনের কাছ থেকে প্রতিবেদন ও সুপারিশ গ্রহণের পর মিয়ানমার সরকার সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল। পরদিন ২৪ আগস্ট আনান কমিশন প্রতিবেদন ও সুপারিশগুলো প্রকাশ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী আরসা রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর চৌকিগুলোতে একযোগে হামলা চালায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার বাহিনী নতুন করে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু করে। ফলে গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত ছয় মাসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

ঢাকার সরকারি সূত্রগুলো বলছে, আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা যোগ করলে এ সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে চলে এসেছে। তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় অবস্থান করছে। সেখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা পাঁচ/ছয় লাখ। আশ্রিত রোহিঙ্গারাই এখন সংখ্যার হিসাবে স্থানীয়দের সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছে।
জাতিসংঘসহ মিয়ানমারের বিদেশি কূটনীতিকরা দাবি করেছেন, ২৫ আগস্ট রাখাইনে কথিত সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান শুরুর বেশ আগে থেকেই সেখানে সামরিক উপস্থিতি জোরদার ও রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছিল। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন অভিযোগ করেছেন, এখনো রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে তাদের বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। নেপিডোতে ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিষয়ক যৌথ কমিটির বৈঠকের আগে ৭ জানুয়ারি রাখাইনে সেনা বহনকারীদের গাড়িতে হামলার অভিযোগ তোলে মিয়ানমার। সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ের বৈঠকগুলোতে মিয়ানমার বাংলাদেশকে বলেছে, কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী আরসা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বানচালের চেষ্টা চালাতে পারে।
আরসার সদস্য কারা এবং তারা কার হয়ে কাজ করছে তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে শর্তসাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে রাজি হলেও দেশটি এমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি যা থেকে রোহিঙ্গারা ফেরার ব্যাপারে উৎসাহিত হতে পারে বা আস্থা ফিরে পেতে পারে। বরং গণহত্যা, নির্যাতন চালিয়েও তা অস্বীকার এবং মিয়ানমার থেকে এখনো বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসার প্রবণতা এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।

এদিকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ছয় মাস পূর্তির প্রাক্কালে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্তেফান দুজারিক গত শুক্রবার রাতে নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের বলেছেন, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) স্পষ্টভাবে বলেছে, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ মিয়ানমারে এখন নেই। কাউকে জোর করে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অমানবিক ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়ার আশঙ্কা করছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গত অক্টোবরে ছয় মাসের জন্য যে তহবিল সংগ্রহ করেছিল তাও প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে এরপর নতুন তহবিল প্রয়োজন হবে। এরই মধ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতালি সফরের সময় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিজলে বলেছেন, দাতারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে আগ্রহ হারাচ্ছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশকে আরো বড় চ্যালেঞ্জে পড়তে হতে পারে।
তবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো সরব রয়েছে। রোহিঙ্গা নিধনের হোতা মিয়ানমারের এক সিনিয়র জেনারেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য ২৮টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও আগামীকাল সোমবার ব্রাসেলসে বৈঠকে ইইউকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানাবেন। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত শুক্রবার নয়াদিল্লিতে বৈঠকে রাখাইন রাজ্যে ও কক্সবাজারে রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ওই দুই দেশ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে নোবেল জয়ী নারীদের পক্ষে গতকাল শনিবার বাংলাদেশে এসেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মারেইড ম্যাগুয়ার, শিরিন এবাদি ও তাওয়াক্কল কারমান। তাঁরা আজ রবিবার কক্সবাজারে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/02/25/606379