২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:০৮

ডলার বাজারে অস্থিরতা

দেশের ডলার বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। টাকার বিপরীতে অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে দাম। বাজারে অতিরিক্ত ডলার ছেড়েও দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। যার প্রভাব পড়ছে আমদানির ক্ষেত্রে। এছাড়া খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়াচ্ছে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি। বর্তমানে এক ডলারের বিপরীতে গুণতে হচ্ছে প্রায় ৮৩-৮৫ টাকা।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাম আরো বেশি নিচ্ছে কিছু ব্যাংক। এদিকে গেল নভেম্বরে ডলার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে তিনটি বিদেশি ও ১৭টি দেশীয়
ব্যাংককে সতর্ক করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকারদের মতে, আমদানি ব্যাপক হারে বাড়লেও রপ্তানি-রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় সেই হারে বাড়ছে না। এতে করে ডলার সংকটে পড়েছে দেশের মুদ্রাবাজার। আবার ব্যাংক খাতে আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়ে গেছে। এসব কারণে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই সতর্ক হতে হবে। কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। দেশের অর্থনীতিতে অপরিহার্য প্রভাব ডলারের।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, অব্যাহতভাবে ডলারের দাম বাড়ায় বাড়ছে আমদানি ব্যয়। ফলে দাম বাড়ছে খাদ্যপণ্যসহ আমদানি পণ্যের। আশঙ্কা মূল্যস্ফীতি বাড়ারও। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত বৃহস্পতিবার গড়ে ৮২ টাকা ৯৪ পয়সা দরে ডলার কেনাবেচা হয়। গত বছরের জানুয়ারিতে যা ছিল ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা। আন্তঃব্যাংক লেনদেনের বাইরে কার্ব মার্কেটে (খোলা বাজারে) ডলারের দাম আরো বেশি। সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসে বাজারে প্রচুর ডলার ছেড়ে দাম ঠিক রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য গত দুই-তিন মাসে দাম ব্যাপকহারে না বাড়লেও ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। এক বছর আগের চেয়ে এখন বেড়েছে প্রায় ৪ টাকা।
এদিকে মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর কর্মকর্তারা জানান, বাজারে ডলারের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রাহকের চাহিদা মতো ডলার বিক্রি করতে পারছি না। বৃহস্পতিবার খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় টাকায় বিক্রি হয়েছে ৮৩ টাকা দরে। আর ক্রয়মূল্য ছিল ৮৩ টাকা ৫০ থেকে ৯০ পয়সার মধ্যে। কয়েকটি ব্যাংক ডলারের ক্রয়মূল্য বেশি নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ডলারের দাম বেশি রাখা হলেও প্রয়োজন অনুপাতে ডলার দিতে পারছে না ব্যাংক এবং মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো। তাদের কাছে ডলার পর্যাপ্ত না থাকায় অল্প করে ডলার বিক্রি করছেন বলে জানান তারা।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত অর্থবছরে এবং তার আগেও ডলারের সরবরাহ বেশি থাকায় প্রচুর ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং আমদানি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা মেটাতে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ১২০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে উঠে এসেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছর ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রির বিপরীতে ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগের অর্থবছর ৪১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনলেও এক ডলারও বিক্রির প্রয়োজন পড়েনি। এর আগের অর্থবছর ৩৭৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার কিনে বিক্রি করে মাত্র ৩৫ কোটি ৭০ ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছর বাজার থেকে ৫১৫ কোটি ডলার কিনলেও কোনো ডলার বিক্রি করেনি। ফলে গত কয়েক বছর ধরে অধিকাংশ ডলার ব্যাংকের কাছে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল।

ভয়েজার মানি এক্সচেঞ্জ হাউজের স্বত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, গতবছরের শেষ নাগাদ ডলারের যে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তা আর কমেনি বরং প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। তিনি বলেন, আমরা পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছি না। গত কয়েকমাস ধরে ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। প্রতি শীত মৌসুমে এমন সংকট থাকলেও অন্য বছরের তুলনায় এ বছর তা অনেক বেশি।

গ্লোবাল মানি চেইঞ্জারের প্রধান নেয়ামত মোল্লাহ বলেন, বাজারে ডলারের সংকট অনেকদিন আগে থেকেই। তবে গত কয়েকদিন ধরে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। আগে বেশিরভাগ প্রবাসীরা রেমিটেন্স বিক্রি করতে আসতো। তারাও এখন কম আসেন। তারা সরাসরি আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের আমদানি বাড়লেও রপ্তানি আয় বাড়েনি। যে কারণে বাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এছাড়াও মেগা প্রজেক্টে ঋণ, উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবের প্রভাব আমরা ডলারের বাজারে দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকবার ডলার ছেড়েও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তবে কিছুটা তো কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু মুদ্রা বাজারের নিয়ন্ত্রক তাই তাদের শক্ত হাতে এটাকে সামলাতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়নমূলক সকল প্রকল্পে দিনদিন খরচ বেড়েই চলেছে। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এগুলো ডলারের বাজারের জন্য অশনি সংকেত। আমাদের আমদানি করা সকল পণ্যও ক্রয় করতে হয় ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমদানির সঙ্গে রপ্তানি ও রেমিটেন্স সমান হারে না বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের আমদানি, খাদ্য আমদানি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ কারণে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমাতে ব্যাংকগুলোকে ইতিমধ্যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) তথ্য মতে, বেসরকারি খাতে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ রয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাপ তৈরি হয়েছে। আবার পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য প্রচুর এলসি খুলতে গিয়ে আমদানিতে ৩০ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশের মতো। আর রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি হলেও দুই বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলে তা কম। এসব কারণে মুদ্রাবাজারে চাপ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি আয় ১ হাজার ৭৬৮ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানি ব্যয় ২ হাজার ৬৩১ কোটি ডলারের বেশি। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতি ৮৬২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯১ ভাগ বেশি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=106306