২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:২১

বইপুস্তক সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : বাংলাদেশের মানুষ এখনও শতভাগ শিক্ষিত নন। গ্রামে-গঞ্জে অনেক নিরক্ষর মানুষের বসবাস হলেও তারা বই বা কিতাব কখনও অসম্মান করেন না। বরং কোনও বইপুস্তক অনিচ্ছাকৃতভাবে হাত থেকে পড়ে গেলে বা কোনওভাবে পায়ের স্পর্শে এলে তা দ্রুত হাতে নিয়ে চুম্বন করেন। এটা শিক্ষিতরাতো করেনই; অশিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষও করেন। অনেক অশিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানহীন বাবা-মা আছেন। ছেলেমেয়েকে স্কুলে নেবার পথে তার কোনও বই নিচে পড়ে গেলে টপ করে তুলে নিয়ে তা কপালে ঠেকান বা চুমু দেন। এটা করেন এ দেশের হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান, সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহালি, মগ, কুকি, তংচংগা সবশ্রেণির মানুষ। অর্থাৎ কেউই বইয়ের অসম্মান করেন না।

পুস্তক অথবা বই বিদ্যা বা জ্ঞানের আধার। জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সর্বত্র। জ্ঞান ব্যতীত কেউ প্রকৃত মানুষ হয় না। হতে পারে না। এজন্য কুরআনের প্রথম বাণীই হচ্ছে: ‘ইকরা’। এর অর্থ পড় বা পাঠ কর। এই পড়া বা পাঠ মানবসভ্যতার সোনালী সোপান। এর মাধ্যম হলো বই বা পুস্তক। তাই বইকে সবাই সম্মান দেয়। সমীহ করে। ইন্টারনেটের যুগে জ্ঞানের মাধ্যম পরিবর্তিত হলেও বইয়ের গুরুত্ব কমেনি। বলতে গেলে এর কোনও বিকল্প নেই। তাই বইয়ের প্রতি ভক্তি বা ভালোবাসা হ্রাস পায়নি। কিন্তু ইন্টারনেটে সেদিন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মহোদয়ের দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত একটি ছবি দেখে যারপরনাই মর্মাহত হতে হলো। ছবিটি বইমেলাতে ধারণ করে কে যেন ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ছবিতে শিক্ষামন্ত্রী নিজের কোল থেকে নামিয়ে একটি শিশুকে বইয়ের দোকানে থরেথরে সাজানো বইয়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। শিশুটির পায়ে জুতো পরানো। শিশুটি অবোধ। তার কোনও অপরাধ নেই। বই না কাগজের স্তূপ তা বুঝবার বোধ তার হয়নি। কিন্তু যিনি শিশুটিকে বইয়ের ওপর দাঁড় করালেন তিনিও কি শিশু? নির্বোধ? অবশ্য নাহিদ সাহেবের হৃদয়ে যে লালিত আদর্শ বিদ্যমান তা একরকম নির্বোধ বা কূপমুণ্ডকেরই। এমন আদর্শের ব্যক্তি না মানেন আসমানি দীন, না মানেন কোনও মানবিক বিশ্বাসবোধ। বইয়ে সাধারণ গল্প-কবিতা ছাড়া পবিত্র কুরআন-হাদিস বা গীতা-বাইবেলের মহাবাণীও থাকতে পারে সেই হুঁশ তার থাকবে কেন?

কথাটা খোলাসা করেই বলি। নাহিদ সাহেব ছাত্রজীবন থেকেই ইসলাম তথা দীনবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ যে-আদর্শ ও বিশ্বাসবোধ ধারণ করেন, তিনি তার বিপরীত। তাই কুরআন-হাদিসের প্রতি তার কোনওরকম শ্রদ্ধাবোধ না থাকবারই কথা। কিন্তু তিনি যে-দেশের মন্ত্রী সে-দেশের ৯০ ভাগ নাগরিকই ইসলামপ্রিয় বা দীনদার। বাকি যেসকল নাগরিক তাদেরও সিংহভাগই কোনও না কোনও আদর্শ বা বিশ্বাসবোধের অনুসারী। কাজেই কোল থেকে শিশু নাতিকে বইমেলার দোকানে বইয়ের ওপর দাঁড় করিয়ে তিনি এদেশের সকল নাগরিকের বিশ্বাসবোধে ঠাস করে কষে চড়ই বসিয়েছেন। তবে এ অমার্জনীয় অপরাধ শিশুটির নয়। শিশুটি যার কোলে ছিল এবং যিনি শিশুটিকে বইয়ের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন অপরাধ তার। মানে মন্ত্রীসাহেবের।
ডিজিটাল যুগে বইয়ের কদর কমে গেছে যারা বলেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন বলে মনে হয়। বইয়ের কদর যদি কমবেই তাহলে বইমেলায় দেখেন না কত ভিড়? প্রতিবছর বইমেলার ভিড়ই বলে দেয় ডিজিটাল ফিজিটাল যাই বলুন বই, বই-ই। এর কোনও বিকল্প নেই। আর থাকবেও না। নতুন বইয়ের যে মজা, ঘ্রাণ এবং এর প্রতি প্রাণের যে টান, তা ডিজিটাল ডিভাইসে নেই।

কুরআন-হাদিস বা গীতা-বাইবেলের সঙ্গে সাধারণ বইয়ের তুলনা করা চলে না। এসবের প্রতি মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা অন্যরকম। এছাড়া সাধারণ বইকেও মানুষ বিশেষত বাঙালি খুব শ্রদ্ধা করে। সমীহ করে। কেউ যদি পড়তে নাও জানে, তাও কিন্তু বইকে অসম্মান করে না। আগেই বলেছি, বই কারুর হাত থেকে নিচে পড়ে গেলে বা কোনওভাবে পায়ের স্পর্শে এলে তা তাড়াতাড়ি করে তুলে নিয়ে চুমু খায় এবং কপালে ঠেকায়। এমনটা করে এদেশের জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষ। এতেই বোঝা যায় মানুষ বইকে কতটা সম্মান করে। গুরুত্ব দেয়। তবে নাহিদ সাহেব সেদিন বইমেলায় যা দেখালেন তা আমাদের কালচারের সঙ্গে মেলে না আদৌ। প্রশ্নটা এখানেই।
মন্ত্রী নাহিদ সাহেব হয়তো বলবেন, একটা বাচ্চাশিশুর কী বোধ আছে যে, ওগুলো বই না কাগজের স্তূপ? হ্যাঁ, শিশুটির তা নেই নিশ্চয়ই। কিন্তু শিশুটি ছিল কার কোলে? ওকে কে নামিয়ে দিয়েছিলেন সাজানো বইয়ের ওপর? শিশুটি নিশ্চয়ই লাফ মেরে বইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে যায়নি। কাজেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা করা কারুর উচিত নয়। সময় থাকতে ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। অন্যথায় এর চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
বই অনেকে এখনও পড়েন। পাঠাগারের টেবিলে বসে পড়েন। কেউ কেউ বাসায় বিছানে শুয়ে শুয়েও পড়েন। কেউ কেউ আবার পড়বার বই অনেক সময় বালিশের মতো করে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়েও পড়েন। কখনও কখনও বই বিছানায় ডানেবাঁয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়েও থাকে। কিন্তু ইচ্ছে করে কোনও বই পায়ের নিচে নিয়ে কোনও মানুষ দলাইমলাই বা দলিতমথিত করেন এমন দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছেন? নিশ্চয়ই না। আমি দেখিনি। কোনও অবোধ বাচ্চা হাতের কাছে কোনও বই পেলে দলাইমলাই করতে পারে। ছিঁড়েছুঁড়ে তা নষ্ট করতেই পারে। কোনও শিশু এমনভাবে বই নষ্ট করলে তার অভিভাবক তথা মা-বাবা, দাদা-দাদি বা অন্যকেউ থাকলে তা ওর কাছ থেকে উদ্ধার করে সেটি রক্ষা করবার চেষ্টা করেন সাধারণত। তবে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেবের পরিবারে এমন কেউ করেন বলে মনে হয় না। অন্তত সেদিন বইমেলায় যা করলেন তা দেখে মানুষের এমন ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক।
বই জ্ঞান বা বিদ্যার প্রতীক। বই মানুষকে পথ দেখায়। আলোর সন্ধান দেয়। বিজ্ঞানসহ নানা বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয়। কীসে অকল্যাণ আর কীসে রয়েছে মানুষের প্রকৃত কল্যাণ তা বাতলে দিতে পারে এ বই। তাই বইয়ের মতো উত্তম বন্ধু এবং ওস্তাদ আর নেই। একটা ভালো বই মানুষকে তার অনিবার্য অধঃপতন থেকে টেনে তুলতে সক্ষম। তাই যারা বইকে পদদলিত করেন বা করান পক্ষান্তরে তারা নিজেরাই পদদলিত হন। জ্ঞান বা বিদ্যা তাদের কাছ থেকে দূরে সরে পড়ে।

সব বই অবশ্য সব মানুষের কাছে প্রিয় হয় না। কোনও কোনও বই বিশেষত তওহিদ বা একত্ববাদ বিষয়ক বই তথা আল্লাহ এবং রসুল মুহাম্মদ (সাঃ) এর বাণী অথবা এ বিষয়ের ওপর বই বহুত্ববাদী কিংবা নাস্তিকরা সহ্য করতে পারেন না। তাদের কাছে এমন বিষয়ে লেখা বই চক্ষুশূল ব্যতীত কিছু নয়। নাস্তিকদের অনেকে মানুষকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখে পৃথিবীর রূপ-রস নিজেরা উপভোগ করতে চান। তবে তথাকথিত সাম্যবাদের ফাঁকা বুলি আওড়াতে তাদের জুড়ি মেলা ভার।

নাহিদ সাহেব শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজিয়েছেন ইতোমধ্যে। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ তাতে তার নিজ থেকেই দায়িত্ব ছেড়ে সরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মন্ত্রিত্বের মায়া ছেড়ে যাওয়া কি এতোই সহজ? তাই মন্ত্রণালয় ছেড়ে চলে যাবার দাবি উঠলেও তিনি অটল এবং অবিচল। তবে সম্প্রতি এ বিষয়ে রিট হয়েছে আদালতে। কিন্তু খুঁটি যখন শক্ত তখন তাকে টলানোটাও সহজ ব্যাপার নয়। এর আগে তিনি নিজেকে চোর বলে স্বীকৃতি দেন। দেশের সবাইকে চোর বানাবার চেষ্টা করেন। পরে অবশ্য নানা রাখঢাক করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেন।
যাই হোক, যে-দেশের ৯০ শতাংশ নাগরিক দীনদার এবং কোনও না কোনও বিশ্বাসবোধের প্রতি আস্থাশীল সে-দেশের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন একজন পাঁড় কমিউনিস্ট। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। যেমন ঘটবার তেমনই ঘটছে। শিক্ষাব্যবস্থা এখন প্রায় ভেঙেই পড়েছে। পরীক্ষার নামে চলছে প্রহসন। প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এর ফল কী হবে তা সবার জানা। ভালো শিক্ষার্থীরা কঠোর পড়াশোনার পরও কাক্সিক্ষত রেজাল্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিচ্ছে তারা করছে ভালো রেজাল্ট। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে ভারসাম্যহীনতা। ভালো শিক্ষার্থীরা ভুগছে হতাশায়। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিচ্ছে তারা ছোটা ষাঁড়ের মতো লেজ তুলে লাফালাফি করছে। এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষাপরিস্থিতি।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যখন একুশের বইমেলায় গিয়ে কোলের নাতিকে সাজানো বইয়ের ওপর নামিয়ে দিয়ে বই পদদলিত বা দলাইমলাই করান তখন সভ্য জাতি হিসেবে আমাদের মুখ দেখাবার সুযোগ থাকে কি? তা কিন্তু মনে হয় না। তবে কমিউনিস্ট মন্ত্রীর এ নিয়ে যে মাথাব্যথার আশঙ্কা নেই, সে সম্পর্কে আমরা প্রায় নিশ্চিত।

 

http://www.dailysangram.com/post/320235