এভাবেই ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এলাকায় শিক্ষার্থী ও মাদকচক্রের অবাধ বিচরণ দেখা যায়।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৪৪

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট

সন্ত্রাস-মাদকে বিপর্যস্ত

♦ ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন
♦ শিক্ষকদের মারধর
♦ বখাটের অত্যাচারে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা

ছাত্রীনিবাসে নিজ কক্ষে পোশাক বদলিয়ে শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এক ছাত্রী। এমন সময় তার এক ছেলে সহপাঠী গোপনে পোশাক পরিবর্তনের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে। পরের দিন সে ওই ছাত্রীকে সেই ভিডিও দৃশ্য দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে। হুমকি দিয়ে বলে, ‘আমাদের কথামতো না চললে এই ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ ওই ছাত্রী তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে মারধর করা হয়।
শুধু তাই নয়, গত ৪ জানুয়ারি দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরিতে অন্য এক ছাত্রী বই পড়ছিল। এমন সময় শিবলী সাদিক নোমান নামের এক ছাত্র সেখানে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে লতিফ ছাত্রাবাসে নিয়ে যেতে চায়। তাৎক্ষণিক ওই ছাত্রী প্রতিবাদ করে। এতে ওই বখাটে ছাত্র মারমুখী হয়ে ওঠে। হাত ধরে টানাটানি করে শারীরিকভাবে অপদস্থ করে ছাত্রীটিকে।

ক্যাম্পাসের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত বখাটে শিবলী একপর্যায়ে ফোন করে তার ঘনিষ্ঠ দুই রাজনৈতিক নেত্রীকে সেখানে ডেকে আনে। এরপর জোরপূর্বক ওই ছাত্রীকে টেনেহিঁচড়ে ইনস্টিটিউটের ছাত্রীনিবাসের একটি রুমে নিয়ে যায়। সেখানে প্রথমে চুল ধরে চড়থাপ্পড় মেরে মাটিতে ফেলে হকিস্টিক দিয়ে পেটায়। আহত ওই ছাত্রী চিৎকার করে সহযোগিতা চাইলে ওই সন্ত্রাসী চক্রের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসার সাহস দেখায়নি। পরে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন মহিলা হলের প্রভোস্ট নাসিমা আক্তার, হল সুপার নরুল আফসার, লতিফ হলের সুপার নুর ইসলামসহ আহত ছাত্রীর সহপাঠীরা। এরপর আহত ছাত্রী তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেছে।
শুধু ছাত্রীদের ওপর হামলার ঘটনাই নয়, মাদকসেবী বখাটেদের অত্যাচারের শিকার শিক্ষকরাও। ওই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই পরীক্ষায় নকল, ক্যাম্পাসে মাদক সেবন, শিক্ষার্থীদের মারধরের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারধরের শিকার হন দুই শিক্ষক। তাঁদের গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এভাবে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠকে বলে, ‘নীরবে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে। মাদক সেবন, ছাত্রীদের গায়ে হাত দেওয়াসহ যা ইচ্ছা তাই করছে তারা। তাদের হাত থেকে শিক্ষকরাও রক্ষা পাচ্ছেন না।’ এ ধরনের আরো অনেক ঘটনার তথ্য-প্রমাণ কালের কণ্ঠ’র হাতে রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুই ছাত্রাবাসেই আলাদা কিছু রুমই রয়েছে, যেখানে নিয়মিত ইয়াবা সেবন ও বিক্রি হয়। এর মধ্যে লতিফ হলের পূর্ব শাখার ২০৩ ও পশ্চিম শাখার ৩১১ নম্বর কক্ষে ফারুক আহমেদ ও আবিরের নেতৃত্বে এক দল মাদকসেবী ছাত্র নিয়মিত ইয়াবা ও ফেনসিডিল সেবন করে। আবার বহিরাগতরাও এখানে মাদক সেবন করে। কাজী মোতাহার হোসেন ছাত্রাবাসে রাকিব ও তাহাসিনের নেতৃত্বে ৩০২ ও ৩০৩ নম্বর কক্ষে মাদক সেবন ও বিক্রি করার তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন এর আগে ৮০০ ইয়াবাসহ একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। পরে জামিন পেয়ে একই কাজ করছে তারা।

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কাছের বেগুনবাড়ী বস্তি, দীপিকার মোড়, আশপাশের রিকশা, ভ্যান, ট্রাকস্ট্যান্ডকেন্দ্রিক এদের মাদক আড্ডা রয়েছে। এসব জায়গায় তারা চাঁদাবাজি করে বলে তথ্য রয়েছে। অতিষ্ঠ বাসিন্দারা থানা পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারকে জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায়ই এই ক্যাম্পাসে নানা ধরনের অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রতি এক ছাত্রীকে মারধরের ঘটনায় মামলা করা হলে দুই ছাত্রীকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রের কারণে পরিস্থিতি পুরোপুরো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এরই মধ্যে এ ধরনের অনেকের নাম পাওয়া গেছে। তাদের দেখা মাত্র গ্রেপ্তার করা হবে।’
জানতে চাইলে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল কাজী জাকির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখতে সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিছু সমস্যা থাকলেও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা : নির্যাতনের শিকার ছাত্রীটির মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘আমাকে প্রথমে শিবলি সাদিক নোমান, সোমাইয়া জামান বিজরী ও তামান্না আক্তার মারধর করে। ওই সময় তারা হুমকি দিয়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে।’

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : মাদকসহ সব ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগের নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ। আবার সভাপতি সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগের কমিটিতেও অনৈতিকভাবে আছেন বলে জানা গেছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত গড়িয়েছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক জরুরি সিদ্ধান্তে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/02/23/605563