২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৪২

২২৬ পৌরসভায় বেতন নেই মাসের পর মাস

স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পৌরসভাগুলো নানা সংকটের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে আর্থিক সংকটই বড়। অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেই। উল্টো চালু আছে ঢালাও কর মওকুফের সংস্কৃতি। দেশের শতকরা ৭৬ ভাগ পৌরসভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাকি আছে দুই মাস থেকে ৫৮ মাসের। বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং চাকরি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নামছেন পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আইন অগ্রাহ্য করে রাজনৈতিক বিবেচনায় গঠিত পৌরসভাগুলো নাগরিক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা কেবল সরকারি বরাদ্দ পাওয়ার আশায় ছোটেন। অপ্রতুল বরাদ্দে ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা।
জানা গেছে, দেশের মোট ৩২৭টি পৌরসভার মধ্যে ২২৬টিতেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাকি আছে। পৌরসভাগুলোর ৩২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করতে বছরে প্রয়োজন ৯৪৭ কোটি টাকা। এই অর্থের মাত্র ০.৪৫ শতাংশ দেয় সরকার, বাকি অংশ পরিশোধ করার কথা পৌরসভার নিজস্ব আয় থেকে। কিন্তু নিজস্ব আয় বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই পৌরসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের।
পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, শতকরা ৭৬ ভাগ পৌরসভাই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছে না। পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া পড়েছে ৫১৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত এক বছর সময়ের মধ্যে পৌরসভার যে ৭৬৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে গেছেন, তাঁদের অবসরকালীন অর্থ পরিশোধ করতে প্রয়োজন ১২৫ কোটি টাকা। দেশের একটি পৌরসভাও এ অবসরকালীন অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না অর্থের অভাবে।

সূত্র মতে, নওগাঁর সান্তাহার পৌরসভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাকি আছে ৫৮ মাসের। এ ছাড়া ভোলার লালমোহনে ৩৩ মাস, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে ৪৬ মাস ও দুপচাঁচিয়ায় ১০ মাস, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ২৪ মাস, রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে ২৪ মাস, খাগড়াছড়ির রামগড়ে ১৮ মাস এবং রাজবাড়ীতে ১২ মাস ধরে বেতন পান না পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পৌরসভা হওয়ার অযোগ্য ও পশ্চাৎপদ এলাকাকে পৌরসভা করা; সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ঢালাও কর মওকুফ করা এবং টেন্ডার ও ইজারা গোপনে নিজস্ব লোকদের দেওয়ার কারণেই পৌরসভাগুলোর এমন আর্থিক সংকট। তাঁরা বলেন, টেন্ডার ও ইজারা থেকে প্রাপ্ত আয় পৌরসভার তহবিলের বদলে মেয়র ও কাউন্সিলরদের পকেটে জমা হয়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বাস্তবে পৌরসভাগুলো এখন নাগরিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরতে পরতে সংকট। বেতনের অভাবে কর্মচারীরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। আইন পাশ কাটিয়ে যেসব জনপদ পৌরসভা করা হয়েছে সেসব ইউনিয়ন পরিষদ থাকাই ভালো ছিল। তিনি মনে করেন, কর নির্ধারণ ও আদায়ের বিষয়টি মেয়রদের বদলে পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর ছাড়লে হয়তো আয় কিছুটা বাড়তে পারত।

স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এর ৩ ধারার ২(ঘ) উপধারা মতে, পৌরসভা গঠন করতে হলে ওই এলাকার জনসংখ্যা কমপক্ষে ৫০ হাজার হতে হবে। দেখা যায়, রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভার জনসংখ্যা ১৯ হাজার ৭৪৫, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ পৌরসভার জনসংখ্যা ২০ হাজার ৭৮০, পটুয়াখালীর গলাচিপা পৌরসভার জনসংখ্যা ২০ হাজার ১৫২, বাউফল পৌরসভার জনসংখ্যা ১৯ হাজার ৬০০ এবং ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার জনসংখ্যা ১৮ হাজার ৯৫৭।
ওই আইনে পৌরসভার শ্রেণিবিন্যাস করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সরকারকে। সে অনুযায়ী সরকার দেশের পৌরসভাগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। শ্রেণিবিন্যাসের শর্ত অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির পৌরসভার নিজস্ব আয় থাকতে হবে ৮০ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণির ৬০ লাখ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণির ৪০ লাখ টাকা। পৌরসভাগুলোর আয়-ব্যয়ের খাত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৮৫টি পৌরসভার বার্ষিক আয় ৩৫ লাখ টাকার নিচে। অথচ এসব পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক বেতনের পরিমাণ ওই আয়ের দেড় গুণ থেকে তিন গুণ পর্যন্ত। ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার বার্ষিক আয় ৩০ লাখ টাকা। অথচ ওই পৌরসভায় কর্মরত ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বার্ষিক বেতনের পরিমাণ ৭২ লাখ টাকা। রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভায় ২০১৭-১৮ সালে ৪৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হলেও নিজস্ব আয় ধরা হয়েছে মাত্র ৩৬ লাখ টাকা। চলতি বছর বাজেটে মেহেরপুর পৌরসভায় টেন্ডার শিডিউল বিক্রির আয় দেখানো হয়েছে শূন্য। অথচ দরপত্র বিক্রয় পৌর আয়ের একটি বড় উৎস। এমন চিত্র আরো অনেক পৌরসভায় দেখা যায়।

অর্থ সংকটে নিয়মিত বেতন-ভাতা না পেয়ে আগামী ১০ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সভাপতি আবদুল আলীম মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দাবি আদায় না হলে আরো বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এটা আমাদের রুটি-রুজির দাবি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের নিয়োগ, বদলি, শাস্তি দেয় সরকার আর বেতন নিতে হয় পৌরসভা থেকে। শতকরা ৭৬ ভাগ পৌরসভায় দুই মাস থেকে ৫৮ মাস বেতন নেই। এমন কিছু এলাকাকে পৌরসভা করা হয়েছে, যেখানে শতভাগ কর আদায় হলেও বেতন পরিশোধ সম্ভব নয়। সেসব কারণে আমরা রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তি চাই।’ পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল মালেক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাদের কোনো দাবি আমরা জানি না। আমাদের কাছে কোনো দাবি তারা করেনি।’ তিনি আরো বলেন, পৌরসভাগুলোর কোনো সংকট নেই।

কুষ্টিয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান আনোয়ার আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের সব পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী একযোগে কর্মবিরতি দিয়ে রাস্তায় নামলে কাজের ক্ষতি হবে, পৌরসভা অচল হবে—এটাই স্বাভাবিক। তিনি আরো বলেন, ‘পৌর কর্মচারীদের দাবি তো যৌক্তিক। বেতন না পেলে তারা খাবে কী, সংসার চলবে কিভাবে?’ তিনি মনে করেন, পৌরসভাগুলোর আয় বাড়ানোর দিকে যেমন নজর দিতে হবে, তেমনি সরকারেরও দায়িত্ব আছে। কর্মচারীরাও দেশের নাগরিক, তাঁদের কথা ভাবতে হবে।

দেশে পৌরসভাগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় সংগঠন মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ পৌরসভা সমিতির সভাপতি ও পাবনা জেলার বেড়া পৌরসভার মেয়র আবদুল বাতেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৌর কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না এটা ঠিক। পৌরসভাগুলোর আয় বৃদ্ধি প্রয়োজন। তবে আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে, যেমন আমরা নিজেদের অর্থে কাগজ-কলম খরচ করে জন্ম নিবন্ধন করি, কর্মচারীরা তাতে কাজ করেন; কিন্তু জন্ম নিবন্ধনের আদায় করা টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হয়। তাহলে আমরা আয় বাড়াব কী করে? আবার সেবার বদলে জনগণের কাছ থেকে সেই পরিমাণ অর্থ আদায় করাও কঠিন। জনগণ দিতে চায় না। বছরে অনুন্নয়ন খাতে পৌরসভাগুলোর প্রয়োজন হয় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সরকার দেয় মাত্র ৫০০ কোটি। এসব নানা কারণে পৌরসভাগুলো সংকটে পড়েছে।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/02/23/605561