২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৪১

আগের রাতেই প্রশ্নফাঁস

পরীক্ষার আগের রাতে হাতে লেখা গণিতের প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ মিলেছে, ইংরেজি ও আইসিটির প্রশ্নও ফাঁস হয় ২ ঘণ্টা আগে * সন্দেহের তীর বিজি প্রেসের দিকে, জিজ্ঞাসাবাদে মিলছে না অনেক প্রশ্নের উত্তর * গোয়েন্দা নজরদারিতে ছাপাখানার সংশ্লিষ্ট ২৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারী


চলমান এসএসসি পরীক্ষার কয়েকটি প্রশ্নপত্র পরীক্ষার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই ফাঁস হয়। এমনকি আগের রাতেও ফাঁস হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। প্রশ্নফাঁসের ধরন এবং তদন্ত ও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এমন তথ্য নিশ্চিত করেন। এমনকি শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান ও সাবেক একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

এদিকে নানা তথ্য বিশ্লেষণের সূত্র ধরে এবারের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সন্দেহের তালিকায় বিজি প্রেসের কর্মকর্তাদের নাম উঠে এসেছে। প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত তদন্তে মাঠপর্যায়ে কাজ করা একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বলছেন, ফাঁসের উৎস খুঁজতে গিয়ে প্রশ্ন ছাপানোর পুরো পদ্ধতির মধ্যে অনেক গলদও পেয়েছেন তারা। তাদের ধারণা, সেই গলদের সুযোগ নিয়েই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিজি প্রেসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে। এই আশঙ্কা থেকে সম্প্রতি প্রশ্নফাঁসের ঘটনা তদন্তে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বিজি প্রেসের কিছু কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু গোয়েন্দাদের অনেক প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি বিজি প্রেসের কর্মকর্তারা।

প্রশ্নপত্রের সুরক্ষার ঘাটতির কারণেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিদ্যমান পদ্ধতিতে প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা আগামী বছর থেকে নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করে পরীক্ষা নিতে চাই। এ ব্যাপারে কাজ চলছে।’ এছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বরাত দিয়ে বলেন, পরীক্ষায় এমসিকিউ বাতিল করা হবে।
সম্প্রতি প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত ১৪ জনকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জিজ্ঞাসাবাদে সংশ্লিষ্ট একজন সিনিয়র কর্মকর্তা রিমান্ডে গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে জানান, শুধু পরীক্ষার আগের রাত কিংবা ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে যাওয়ার সময়ই নয়, ছাপাখানা বা সেখানে যাওয়ার আগেই হাতে লেখা প্রশ্নই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।

ওই সূত্রটি আরও জানায়, প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যদের ধরতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ডিবি কঠোর নজরদারির জাল পাতে। সে সময় গণিত পরীক্ষার আগের রাতে হাতে লেখা প্রশ্নপত্র কয়েকটি ফেসবুক পেজে চলে আসে। সেটি তারা সংগ্রহে রাখেন। পরদিন পরীক্ষার পর দেখা যায় হাতে লেখা সেই প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে বলে, প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্তরের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের ভিত্তিতে মূল হোতা শনাক্তের চেষ্টা চলছে। তবে তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করা যাবে না।
অবশ্য হাতে লেখা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বোর্ড থেকে হাতে লেখা প্রশ্নফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। কারণ একটি নির্দিষ্ট ফন্ট ও ফরমেটের মাধ্যমে শিক্ষকরা প্রশ্ন লেখেন। যেসব হাতে লেখা প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে সেগুলো বিভিন্ন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সাজেশনের কপি।

তবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক একজন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এবার ইংরেজির একটি বিষয় এবং আইসিটির প্রশ্নপত্রের দুটি সেটই ফাঁস হয়েছে। অপরদিকে গোয়েন্দারা বলছেন, হাতে লেখা প্রশ্নপত্র আগের রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া গেছে। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই বলা যায়, পরীক্ষার শুরুর বিশেষ করে ট্রেজারি খোলার বহু আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। কেননা সর্বনিু সাড়ে ৭টার দিকে ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়। যদি আগের রাতে প্রশ্ন মেলে, তাহলে ধরে নিতে হবে এর আগের কোনো এক স্তর থেকে প্রশ্নফাঁস হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তবে শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রশ্নফাঁসের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কেননা প্রশ্নপত্র যারা তৈরি করেন তারাই সিলগালা করে রেখে দেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পর্যন্ত তা দেখতে পারেন না। লটারিতে নির্বাচিত প্যাকেট সিলগালা অবস্থায় সরাসরি চলে যায় বিজি প্রেসে।

একই কথা বলেন ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার। তিনি জানান, দেশের সিনিয়র শিক্ষকরা শিক্ষা বোর্ডের কার্যালয়ে এসে একটি নির্দিষ্ট ফরমেটের কাগজে নিজ নিজ প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। এরপর মডারেটররা প্রশ্নগুলো নির্বাচন করেন। নির্বাচিত প্রশ্নগুলো একাধিক প্যাকেটে খামবন্দি করে খামগুলো সিলগালা করা হয়। মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সেগুলোর মধ্যে লটারি হয়। লটারিতে উঠে আসা প্রশ্নটি না খুলেই সরাসরি বিজি প্রেসে পাঠানো হয়। এরপর কড়া সতর্কতার মধ্যে সেগুলো ছাপানো হয়।
তবে ঢাকা বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তার বক্তব্যের সঙ্গে প্রশ্নফাঁস তদন্তে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্যেরও মিল পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের নজর সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসের দিকে। গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে- বিজি প্রেসের এমন কিছু সম্ভাব্য জায়গা চিহ্নিত করা হয়। এরপর বিজি প্রেসের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের পয়েন্ট ধরে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা গোয়েন্দাদের করা অনেক প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বোর্ড প্রশ্ন তৈরি করে দুই সেট বিজি প্রেসে পাঠায়। বিজি প্রেসে দায়িত্বে থাকা ১৫-২০ জন ওই প্রশ্ন কম্পোজ করেন। পরে কম্পোজ করা প্রশ্নের প্র“ফ দেখেন প্র“ফ সেকশনের ছয়জন। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সঙ্গে এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তত ২৪০ জন জড়িত রয়েছে। প্রশ্নপত্র ছাপানোর পর ১২ থেকে ১৪ জন মিলে গুনে গুনে প্যাকেট করে সিলগালা করে। এই প্যাকেট পদ্ধতি অটোমেশনের জন্য আমরা চার বছর আগেও সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। এটাকে প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

আরেকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ছাপানো কার্যক্রম চলে ৪০ দিন ধরে। এ সময় প্রশ্ন রাখা হয় বিজি প্রেসে। অপরদিকে যেসব পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে অনেকগুলো ফাঁকফোকর রয়েছে। যারা ওপরের কাজগুলো করেন, তারা একই কাজ দীর্ঘদিন ধরে করছেন। ফলে উল্লিখিত পর্যায়ে জড়িতরা সিন্ডিকেট করে প্রশ্ন মুখস্থ করে হাতে লিখে ফাঁস করে দিতে পারে। গণিতের হাতে লেখা প্রশ্নই এ ক্ষেত্রে বড় সংশয় নিয়ে হাজির হয়েছে। এছাড়া প্রশ্ন ছাপানোর পর প্লেটগুলো নষ্ট করে দেয়ার কথা থাকলেও গোয়েন্দারা বিজি প্রেসে গিয়ে ছাপানো প্রশ্নের প্লেট পেয়েছেন। এভাবে প্রশ্নফাঁসের উৎস হিসেবে আরও বেশ কয়েকটি দিক চিহ্নিত করেছেন গোয়েন্দারা।
কয়েক বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পরীক্ষা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে থাকা একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, প্রশ্নফাঁস বন্ধে আমরা আটটি সুপারিশ করেছিলাম। এর মধ্যে আছে- নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন অবশ্যই বাতিল করতে হবে; প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি সংশোধন করতে হবে; প্রচলিত আইন সংশোধন করে প্রশ্নফাঁসের মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আইনে বিচার করতে হবে; কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে হবে; পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি ডিজিটাল করতে হবে। সুপারিশগুলোর মধ্য থেকে চারটি সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ড।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে বলেন, প্রশ্ন তৈরির কার্যক্রমে বিজি প্রেসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সেখানে প্রায় ৬ সপ্তাহ ধরে প্রশ্নপত্র মুদ্রণ ও প্যাকেজিং কাজ চলে। এ সময় যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এই কাজে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট থাকেন, তাদের কারও গাফিলতি আছে কিনা তাও আমরা তদন্ত করছি। তিনি আরও বলেন, অতীতেও প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় বিজি প্রেসের লোকজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাও আমরা বিবেচনায় রেখেছি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/20468