২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৩৭

দুই শতাধিক স্পটে দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক মহসিন বেপারী গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর যাচ্ছিলেন ছোট ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কথা ছিল সদরঘাট থেকে শরীয়তপুরের লঞ্চে উঠবেন। যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে সদরঘাটে যাওয়ার পথে লক্ষ্মীবাজার এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন তিনি। ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হন মহসিন। দুর্বৃত্তরা তার পায়ে ছুরিকাঘাত করে এক লাখ ৪৬ হাজার টাকা কেড়ে নিয়ে যায়। আহত মহসিনকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। ঘটনাটি ঘটে মঙ্গলবার সকালে। এভাবেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্বৃত্তদের কবলে পড়ে অর্থকড়ি হারাচ্ছেন অনেকেই। রাজধানীতে দুই শতাধিক স্পট রয়েছে, যেখানে প্রায়ই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন পথচারীরা। দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রাণও হারাতে হচ্ছে ঘটনার শিকার লোকজনকে। আবার অনেকে আহত হচ্ছেন এ ধরনের ঘটনায়। এভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটলেও দু-চারজন দুর্বৃত্ত গ্রেফতার হওয়ার খবর মিলছে। বাকিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দু-চারজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতারের খবর দিলেও ভুক্তভোগীদের খোয়া যাওয়া অর্থকড়ি ও মালামাল উদ্ধারের ঘটনা নেই বললেই চলে।

গত ডিসেম্বরে দয়াগঞ্জে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে আরাফাত নামের ৫ মাসের এক শিশু প্রাণ হারায়। সে শরীয়তপুরের শাহ আলম ও আকলিমা বেগমের সন্তান। অন্য সন্তান আল-আমিনের (২) চিকিৎসার জন্য লঞ্চে তারা রাজধানীর সদরঘাটে আসেন। সেখান থেকে শনির আখড়ায় বোনের বাসায় যাওয়ার পথে তারা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা আকলিমার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিলে শিশু আরাফাত রাস্তায় ছিটকে পড়ে। সেখানে তার মৃত্যু হয়। শিশু আরাফাতের মৃত্যুর পর ওই এলাকার বাসিন্দারা ধারণা করেছিলেন সেখানে ছিনতাইয়ের ঘটনা কমবে। কিন্তু কমেনি। উল্টো দয়াগঞ্জ ও এর আশপাশে দুর্বৃত্তদের অত্যাচার আরো বেড়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। সন্ধ্যার পর ও ভোরে ওই এলাকার রাস্তা দিয়ে লোকজন চলতে ভয় পান।
কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়েও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডে একটি পোশাক কারখানার ৪০ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। দুর্বৃত্তরা নিজেদেরকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে গাড়ি আটকে ওই টাকা নিয়ে যায়। এ সময় ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাসহ দু’জনকে বেদম মারধর করে দুর্বৃত্তরা। ডিবি পরিচয়দানকারী ওই দুর্বৃত্তদের কাছে রিভলবার, ওয়াকিটকি ও হাতকড়াসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ছিল। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও উদ্ধার হয়নি লুণ্ঠিত টাকা।
গত ২৯ নভেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ডাক্তার ফরহাদ আলম। ছিনতাইকারীদের টানা-হেচড়ায় রিকশা থেকে পড়ে যান ডাক্তার ফরহাদ। এতে তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার তিনি মারা যান।

রাজধানীর সদরঘাট ও এর আশপাশের এলাকা, শাপলা চত্বর থেকে টিকাটুলী মোড়, গোপীবাগের রাস্তা, মতিঝিল কালভার্ট রোড হয়ে আরামবাগ, মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির পাশের রাস্তা, পীরজঙ্গির মাজার, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের আপশাশের এলাকা, যাত্রাবাড়ী মোড়, জুরাইন রেলগেট থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ, পুরানা পল্টন মোড়, চানখাঁরপুল, পলাশী, কাকরাইল মোড় থেকে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল মোড়, রাজারবাগ পূর্বপাশের মোড় থেকে শাহজাহানপুর রেললাইন, ফার্মগেট ওভারব্রিজ এলাকা, মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ মোড়, দোয়েল চত্বর থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রাস্তা, নিউমার্কেটের দক্ষিণ দিকের রাস্তা, আজিমপুর মোড়, ধানমন্ডি ২ নম্বর রাস্তা ও নয়াবাজার থেকে গাবতলী বেড়িবাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টসহ রাজধানীর দুই শতাধিক স্পটে এখন দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া। ঘটছে একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা। কামরাঙ্গীরচরের বেড়িবাঁধ এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ।
রাজধানীতে প্রায়ই দামি গাড়ি ও মোটরসাইকেলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। প্রধান প্রধান সড়কেই এই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে আসছে। গত বছর ১৯ নভেম্বর সকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম দম্পতি। তারা কলেজ গেট থেকে রিকশায় আজিমপুরের বাসায় যাচ্ছিলেন। সাড়ে ৬টার দিকে তাদের বহনকারী রিকশাটি নিউমার্কেট এলাকায় পৌঁছলে একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কার থেকে শফিকের স্ত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগ টেনে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।

গত ৪ নভেম্বর রাজধানীর শাপলা চত্বর এলাকায় অপর এক দম্পতি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। তারা রিকশায় যাওয়ার সময় একটি চলন্ত গাড়ি থেকে ছোঁ মেরে ভ্যানিটি ব্যাগ কেড়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ এলাকায়ও প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। গত ৮ অক্টোবর ভোরে একই এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আবু তালহা নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নিহত হয়। তালহা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ভোরে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার জন্য নিজ বাসা থেকে বের হয়ে বাসার সামনের রাস্তায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে দেখে তালহা ছিনতাইকারীদের ধাওয়া করে। এ সময় এক ছিনতাইকারীকে ধরে ফেললে তার সঙ্গীরা তালহাকে ছুরিকাঘাত করে। এতে তালহা নিহত হন।

অভিযোগ রয়েছে পুলিশের চোখের সামনে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ থাকে নির্বিকার। সাজ্জাদ নূর সুমন নামের এক নাটক নির্মাতা গত বছর ১১ ডিসেম্বর বিমানবন্দর সড়কে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। সেখানে ছিনতাইকারীদের ধারাল অস্ত্রের আঘাতে তিনি আহত হন। পুলিশের সামনেই এ ঘটনা ঘটে। সাজ্জাদ পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাননি।

ছিনতাইকারীদের অত্যাচার এতটাই মাত্রা ছাড়িয়েছে যে বিষয়টি সম্প্রতি জাতীয় সংসদ পর্যন্ত গড়ায়। সংসদ অধিবেশনে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার জবাবে বলেছেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ছিনতাই প্রতিরোধ ও জনসাধারণের নিরবচ্ছিন্ন চলাচল নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদপে নেয়া হয়েছে। পুলিশি টহল জোরদার ও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রাস্তায় পুলিশি চেকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্দেহভাজন মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রো বাস ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হচ্ছে। সংসদে সরকারি দলের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/296115