২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০১

ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট

ফারমার্স ব্যাংকের জের ; বিভিন্ন ব্যাংকের সরকারি আমানত যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে ; ধার করে চলছে নতুন ব্যাংকগুলো

ব্যাংকিং খাতে হঠাৎ করে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলোর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। টাকার সঙ্কটে অনেক ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তহবিল সংগ্রহে তাই মরিয়া হয়ে উঠেছে কোনো কোনো ব্যাংক। প্রতিদিন কলমানি মার্কেট (আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার) থেকে ধার করে চলার পাশাপাশি সঙ্কট মেটাতে আমানতের সুদ হার বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যাংকিং খাতে হঠাৎ করে এমন টাকার সঙ্কটের জন্য প্রধানত তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন ব্যাংকাররা। প্রথম কারণ হলো ফারমার্স ব্যাংক সঙ্কট। জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার তহবিল ব্যাংকগুলোতে আমানত রাখা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইচ্ছে মাফিক ব্যাংকগুলোতে আমানত রাখতে পারে না। এর জন্য কোটা দেয়া আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৭৫ ভাগ বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। বাকি ২৫ শতাংশ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে রাখতে পারে। জানা গেছে, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু তহবিলের ৫০৩ কোটি টাকা ফারমার্স ব্যাংকে জমা রাখা হয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতো সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ফারমার্স ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকেও তাদের টাকা গচ্ছিত রেখেছে। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে ব্যাংকটি চরম তহবিল সঙ্কটে পড়ে। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী তহবিল ফেরত দিতে পারছে না। বিশেষ করে জলবায়ু তহবিলের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয়। ফারমার্স ব্যাংক থেকে অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। সরকারি তহবিলের অর্থ জমা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রশ্ন উঠে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পুরো তহবিল বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে কিভাবে। সমালোচনা ও বিতর্ক এড়াতে তড়িঘড়ি করে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। নিয়মের মধ্যে থাকার জন্য আমানত রাখছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে। আমানত প্রত্যাহার করায় অনেক ব্যাংক বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলোর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা বিরাজ করছে। অনেকেই আমানতের সুদ হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে ধার করছে কলমানি মার্কেট থেকে। সরকারি ব্যাংকগুলো টাকা খাটাতে না পেরে এখন কলমানি মার্কেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকে ধার দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ১৫ফেব্রুয়ারি কলমানি মার্কেটে ৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি তিন ব্যাংক সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক ধার দিয়েছে ৪ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। ১৮ ফেব্রুয়ারি ৭ হাজার ২৪২ কোটি টাকার মধ্যে সরকারি চার ব্যাংকই ধার দিয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। আর ১৯ ফেব্রুয়ারি ৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার মধ্যে সরকারি চার ব্যাংক ধার দিয়েছে ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

ব্যাংকিং খাতে টাকা সঙ্কটের দ্বিতীয় কারণ হলো অতিমাত্রায় আগ্রাসী ব্যাংকিং। গত কয়েক মাস ব্যাপকভিত্তিতে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু তহবিল সংস্থান না করেই এ আমদানি ঋণপত্র স্থাপন করার (এলসি খোলার আগে) তহবিল সংস্থান করেনি। ফলে পণ্য আমদানির দায় মেটানোর সময় ডলারের সঙ্কট দেখা দেয়। এ সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রায় দেড় শ’ কোটি ডলারের জোগান দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ওই পরিমাণ ডলার বাজার মূল্যে কিনে নিয়েছে। এতে ডলার বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। এখনো সঙ্কট মেটাতে প্রতি দিনই রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বাজারে নগদ টাকার প্রবাহে কিছুটা চাপ বেড়ে গেছে।

টাকা সঙ্কটের আরেক কারণ হলো ঋণ আমানতের অনুপাত কমানো। আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে অনেক ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক তার মোট তহবিলের ৮৫ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো ব্যাংক শতভাগ বিনিয়োগ করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধে ঋণ আমানতের অনুপাত প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে আনে। আর ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ থেকে ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনে। প্রথমে সময় দেয়া হয় ৬ মাস। পরে তা সংশোধন করে এক বছরের সময় দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো যে বাড়তি বিনিয়োগ করেছিল তা রাতারাতি প্রত্যাহার করতে পারে না। ফলে ঋণ আমানতের অনুপাত নির্ধারিত সীমার মধ্যে আনতে আমানত সংগ্রহ করছে। এভাবেই বাজারে নগদ টাকার সরবরাহে চাপ বেড়ে যায়। এ চাপের ফলেই আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ঋণের সুদহারও বেড়ে যাচ্ছে। তহবিল ব্যবস্থাপনার এ বিশৃঙ্খলা ব্যাংকিং খাতের জন্য সামনে ভালো ফল বয়ে আনবে না বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/295934