২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৪

পরীক্ষাসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন

ড. গাজী মো: আহসানুল কবীর
দেশের স্বার্থে ও শিক্ষার স্বার্থে আবেদন, আসুন পরীক্ষার বোঝা কমিয়ে আরো উপভোগ্য জ্ঞান উপকরণে শিক্ষাজীবনের আঙ্গিনাকে সাজাই। বারবার এক্সপেরিমেন্টের হাতিয়ার না বানিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উপভোগ্য ও ভারমুক্ত শিক্ষাজীবনের ব্যবস্থা করি

একসময় শুনেছি, জীবন মানেই বঞ্চনা। এর সাথে মিল রেখেই বোধহয় এখন দেখছিÑ আমাদের দেশে জীবন মানেই ‘পরীক্ষা’, আর পরীক্ষা মানেই ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’। পরীক্ষা হবে আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, তা কি হয়? সুতরাং আবারো প্রশ্নপত্র ফাঁস। আবারো অস্বীকৃতির নাটক, হুঙ্কার আর পাল্টা হুঙ্কার। এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দুই দিনেই বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ, এরপর আবার নাকি ইংরেজি, গণিত কিছুই বাদ যায়নি। যথারীতি ফাঁসকারীরা পূর্ব ঘোষণা দিয়েই ফাঁস করেছে, আর আমাদের পক্ষ থেকে প্রথমেই অস্বীকার। কিন্তু সুস্পষ্ট প্রমাণ হাজির করার পর মৃদু আমতা আমতা করে স্বীকার করে নেয়া। ফাঁসের প্রমাণ যাচাইয়ের জন্য কমিটি গঠন এবং ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা। এ কমিটি নাকি যাচাই করে দেখবে, আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কি-না এবং প্রশ্নফাঁস হয়ে থাকলে কী ধরনের ক্ষতি হলো। কী হাস্যকর সব কথাবার্তা! ফঁাঁস হওয়া সেটের সাথে প্রশ্ন হুবহু মিলে গেল। এরপরও নাকি মিলিয়ে দেখার বাকি আছে। প্রশ্নফাঁসের ফলে কী ক্ষতি হলো, এটা কি বলার অপেক্ষা রাখে? সবচেয়ে হাস্যস্পদ হলো পুরস্কার ঘোষণাÑ‘একে ধরিয়ে দিন আর পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার বুঝে নিন’। কিন্তু কাকে ধরিয়ে দেবে? নাম-ধাম-পরিচয় তো নেই। আগে দেখতাম, নাম-ঠিকানাসহ ছবি ছাপিয়ে ধরিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ থাকত। এখন আপনাকেই বলা হচ্ছে আসামি খুঁজে বের করে ধরিয়ে দিতে। কেউ যদি সামাজিক মাধ্যমে ক্ষমতাধর কারো বিরুদ্ধে আপত্তিকর স্ট্যাটাস পোস্ট করে, সেটি ধরতে এক মিনিট দেরি হয় না। তাকে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে ধরে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। তাহলে, এ ক্ষেত্রে কেন পারছেন না? এমন অসহায় আর্তনাদসহ পুরস্কার ঘোষণা করতে হলো কেন? চারদিকে মানুষের ধারণা হয়েছে, আসলে এ সবই সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস। প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরার ব্যাপারে ন্যূনতম আন্তরিকতা থাকলেও এমন সময় ক্ষেপণ করা হতো না। টালবাহানারও প্রয়োজন পড়ত না।
মাঝখান থেকে পরীক্ষা বাতিলের শঙ্কায় উদ্বিগ্ন লাখ লাখ পরীক্ষার্থী-অভিভাবক। অন্য কেউ এ সমস্যা বুঝবেন না। সমস্যা হাড়ে হাড়ে টের পায় পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা। প্রশ্নফাঁস হোক আর ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পরীক্ষা বাতিল হোকÑ দু’ক্ষেত্রেই মূল ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হলো পরীক্ষার্থীরা। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যারা পায়নি, এত কষ্ট করে পড়ালেখা করে প্রস্তুতি নিয়েছে, তাদের দোষ কী? সিস্টেমের ফাঁদে ফেলে তাদের ভোগান্তি কেন? এটি তো রীতিমতো তাদের অধিকার ক্ষুণœ করার উদ্যোগ। লোকজনের মনে যে প্রশ্নটি দানা বেঁধেছে তা হলো, সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ের ক্যামব্রিজ থেকে প্রশ্ন এনে ব্রিটিশ কাউন্সিল বা EDEXEL বিশ^ব্যাপী যে ‘ও-লেভেল’ এবং ‘এ-লেভেল’-এর পরীক্ষা নিচ্ছে, সে প্রশ্ন তো কখনো ফাঁস হতে শুনিনি! তাহলে আমাদের সব প্রশ্নপত্র কেন অবিরাম ফাঁস হয়ে চলেছে? তাহলে কি ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’? তাই সবার একটাই আরজিÑ দোহাই, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে এ প্রহসনের পরীক্ষা আর নেবেন না। প্রশ্নফাঁস হওয়া আপনারা বন্ধ করতে পারবেন না। তাই ফাঁসমুক্ত প্রশ্নে যারা পরীক্ষা পরিচালনা করার যোগ্যতা রাখেন তাদের সাহায্য নিন, পরামর্শ নিন। Outsourcing করুন। অথবা অন্য কোনো বিকল্প ভাবুন।

একসময় হলে হলে নকলের হিড়িক আর অধুনা প্রশ্নফাঁসের তাণ্ডব; কী হচ্ছে এসব আমাদের শিক্ষাজগতে? সমস্যাকে আড়াল করলে সমাধান আসবে না, সমস্যা থেকেই যাবে। রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার কাহিনী স্মরণ করেই বলতে হয়, সমস্যাকে আড়াল করার জন্য সারা দেশ চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের পা দুটো চামড়ায় মুড়ে দিলেই চলবে। অর্থাৎ বলছিলাম, প্রশ্নফাঁস রোধের নিষ্ফল আস্ফালন না করে সিস্টেমের দিকে নজর দেয়া জরুরি। পরীক্ষাসর্বস্ব এবং নম্বরপত্রনির্ভর সিস্টেমের পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশাল কর্মযজ্ঞপূর্ণ বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিক পরীক্ষার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এর ভূমিকা হালকা করে দিতে হবে, যাতে একটি মাত্র পরীক্ষার জন্য অর্থ-মান বিসর্জন দেয়ার মতো ‘মোরগ যুদ্ধ’ করার প্রয়োজন না পড়ে। শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতির অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আজ হোক কাল হোক, এর কোনো বিকল্প নেই। মূল্যায়ন পদ্ধতিকে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষাকেন্দ্রে আবদ্ধ না রেখে এটিকে শিক্ষার্থীবান্ধব শ্রেণিকক্ষে নিয়ে যেতে হবে। ‘এক মাস দীর্ঘ পরীক্ষাময় কর্মকাণ্ডের’ মধ্যে একে সীমাবদ্ধ না করে পুরো শিক্ষা জীবনব্যাপী মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি শ্রেণীতে দৈনন্দিন পাঠ চলার সময় শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের কাজের মূল্যায়ন করবেন। এক একটি শ্রেণীর বার্ষিক পাঠ শেষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর বার্ষিক মূল্যায়নের সিজিপিএ হবে। এভাবে প্রতিটি কাসে প্রতিটি ধাপে মূল্যায়ন চলবে। সব শিক্ষার্থীর প্রতি বছরের অর্জিত সিজিপিএর রেকর্ড বছর শেষে বিদ্যালয় বা কলেজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাবোর্ডে পাঠাতে হবে এবং তা সংরক্ষণ করা হবে। পাঁচ বছরের প্রাথমিক এবং পাঁচ বছরের মাধ্যমিক পাঠ শেষে এক একটি সামগ্রিক সিজিপিএ অর্জিত হবে। কোর্স শেষে একটি আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা নিতে হবে অবশ্যই। তবে এটা এখনকার মতো এত ব্যাপক আকারে নয় এবং এটাই শিক্ষার্থী মূল্যায়নের একমাত্র হাতিয়ার হওয়া উচিত নয়। পাঁচ বছরের প্রাপ্ত সিজিপিএর সাথে এ পরীক্ষার অর্জনকে সমন্বয় করেই একজন শিক্ষার্থীর সার্বিক মূল্যায়ন করতে হবে। বিশে^র বিভিন্ন দেশের ব্যবস্থা সম্পর্কে একটুখানি খোঁজখবর নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে মূল্যায়ন পদ্ধতির একটি পুনর্মূল্যায়ন যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই মঙ্গল। এটুকুই শুধু বলতে পারি, দু’দিন আগে হোক পরে হোক, এটি করতেই হবে।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা পরিষ্কার করে বলা ভালো। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এভাবে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে অতি আনুকূল্য দেখাবেন। দেখাতে পারেন। তবে পরবর্তী শিক্ষাস্তরে ভর্তি বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পথে প্রতিটি এন্ট্রি পয়েন্টে যখন টেস্ট বা ইন্টারভিউ হবে, তখন এসব জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। ফলে যারা স্বজনপ্রীতি করে, তারা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই এসব অপচেষ্টা থেকে সরে আসবেন। একসময় অবশ্যই একটি টেকসই সিস্টেম গড়ে উঠবে। তাছাড়া এটি যে একেবারেই নতুন একটি সিস্টেম, তা কিন্তু নয়। এখনো তো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের একটি বড় অংশই শিক্ষকরা করে থাকেন। সুতরাং, সে ক্ষেত্রে আরো একটু আগে থেকে প্রক্রিয়াটি প্র্যাকটিসে আনা আর কি।

পরিশেষে দেশের স্বার্থে ও শিক্ষার স্বার্থে আবেদন, আসুন পরীক্ষার বোঝা কমিয়ে আরো উপভোগ্য জ্ঞান উপকরণে শিক্ষাজীবনের আঙ্গিনাকে সাজাই। বারবার এক্সপেরিমেন্টের হাতিয়ার না বানিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উপভোগ্য ও ভারমুক্ত শিক্ষাজীবনের ব্যবস্থা করি। তারা জ্ঞানার্জন করুক, হাসিখুশি মনে সৃজনশীলতার পথ ধরেই চলুক, হয়ে উঠুক দক্ষতা সমৃদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য নাগরিক।হ
লেখক : প্রফেসর, রসায়ন এবং প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/295838