২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৫২

অপরাধীরা চাদরের নীচেই ওম নিচ্ছে

পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার বারআনি গ্রামে তাফসিরুল কোরআন মাহফিলে এক ন্যক্কারজনক ঘটনার খবর মুদ্রিত হয়েছে দৈনিক সংগ্রামে। ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, ১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত মাহফিলের প্রধান অতিথি মাওলানা আজিজুল হককে বেদম প্রহার করেছে ধুলাউড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জরিফ আহমেদ মাস্টার, সেক্রেটারি রঞ্জু ফকিরসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা। একটি কথাকে কেন্দ্র করে মাহফিলের প্যান্ডেলসহ পুরো এলাকার লাইট বন্ধ করে দিয়ে তারা বক্তব্য পেশকারী মাওলানাকে নির্মমভাবে প্রহার করে।

বিবেচনার বিষয় হলো, মাহফিলের সম্মানিত আলেম এমন কী বলেছেন যে, যার জন্য তাকে প্রহার করতে বাধ্য হলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকর্মীরা? পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মাওলানা সাহেব যখন বললেন ‘আবু জেহেলের বংশধর এখনো আছে’, তখনই তার ওপর হামলা চালায় অভিযুক্তরা। প্রশ্ন জাগে এই বক্তব্যে এমন কি ভুল আছে যে, যার জন্য মাওলানার ওপর হামলা চালালো আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা? মূর্খতাপূর্ণ আচরণের জন্যইতো আরবের তৎকালীন শীর্ষ নেতা ‘আবু জেহেল’ তথা ‘মূর্খের পিতা’ উপাধি পেয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে কি আমাদের সমাজে বহুলোক মূর্খতাপূর্ণ আচরণ করছেন না? প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা উল্টালেইতো তার বহু উদাহরণ পাওয়া যায়।
মাওলানা সাহেবতো সঠিক কথাই বলেছেন। আর সঠিক ও সত্য কথা বলার জন্য মাওলানার ওপর যারা হামলা চালালেন, তাদের আমরা কোন্ বিশেষণে অভিহিত করবো? তারাতো অবশ্যই মূর্খতাপূর্ণ আচরণ করেছেন। এখন কেউ যদি বলেন, মাওলানা তো ঠিকই বলেছেন যে ‘আবু জেহেলের বংশধর এখনো আছে’, তবে তাকে কি মন্দ বলা যাবে?

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ওই স্থানীয় নেতা সবকিছু নিজের ইচ্ছামতো চালাতে চান, এমনকি তাফসির মাহফিলও! তার মতের বাইরে কিছু গেলেই মহাবিপদ। তাফসির মাহফিল প- করার ঘটনা তার বড় উদাহরণ। আর জরিফ মাস্টারসহ তার সাঙ্গপাঙ্গরা যেভাবে মাওলানার ওপর হামলা চালিয়েছেন তাতো রীতিমত সন্ত্রাসী ঘটনা। আমরা মনে করি এ কারণে তাদের আইনের আওতায় নেওয়া প্রয়োজন। পুলিশ ও প্রশাসন যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে কিনাÑ সেটাই এখন দেখার বিষয়। আর সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল হিসেবে এ রকম সন্ত্রাসী ঘটনা প্রশ্রয় পেলে আওয়ামী লীগের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কি ব্যবস্থা নেয়- সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে জনগণের জন্য। তবে দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান বিশ্ব বাতাবরণে সন্ত্রাস প্রসঙ্গে রকমফের লক্ষ্য করা যায়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সবাই অন্যের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে। কিন্তু নিজের চাদরের নীচে যে সন্ত্রাসী ওম নিচ্ছে, তা কেউ স্বীকার করতে চায় না। এমন প্রহসন মেনে নেওয়া যায় না। প্রহসন ও শঠতার কারণেই আমরা এখনো মানসম্পন্ন সমাজ নির্মাণ করতে পরিনি।

সমাজের মান নির্ণয়ে নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে সমাজের মান নির্ণয়ের কাজটি সম্পন্ন করা যায় না। এমন বিবেচনা আমাদের সমাজের জন্য এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যখন পত্রিকার শিরোনাম হয় ‘পুলিশের ঘুষ মাদকে উশুল’, তখন আমাদের থমকে যেতে হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, পুলিশের ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে দেশে মাদক ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না। শুধু মাদক ব্যবসা নয়, বাহিনীতে লোকবল নিয়োগ, পদায়ন ও বদলিতেও ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। এই ঘুষের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারাও জড়িত। ১৮ ফেব্রুয়ারি অপরাধ বিষয়ক ত্রৈমাসিক সভায় পুলিশের কর্মকর্তাদের আলোচনায় এসব বিষয় ওঠে আসে বলে সভা সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য যে, পুলিশের সদর দফতর সম্মেলন কক্ষে ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, নতুন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীর উপস্থিতিতে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের নিজস্ব সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এক পুলিশ কর্মকর্তা মাদক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, কাকের মাংস কাকে খায় না, কিন্তু পুলিশের মাংস যদি পুলিশে খায় তাহলে অপরাধ বন্ধ হবে কীভাবে? ওই কর্মকর্তা বলেন, কোন কোন থানায় নতুন ওসি যোগদান করতে হলে তাকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। শুধু ওসি নন, এসআই এবং এএসআই বদলি করতেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এতো টাকা ঘুষ দেওয়ার পর ওই কর্মকর্তা মাদকের সাথে যুক্ত হবেন এটাইতো স্বাভাবিক। কারণ ঘুষের এই অর্থ তিনি তুলবেন কী করে? আবার জেলার প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা যদি ওসি থেকে টাকা নেন তাহলে তাকে মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে বলবেন কীভাবে? মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও ডিআইজিরাও টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিচ্ছেন। যে কারণে মাদকের সঙ্গে পুলিশের সংযোগ কমছে না, মাদক বন্ধও হচ্ছে না। পুলিশের ঘুষের টাকা মাদকে উশুল হচ্ছে।
পুলিশের আইজি অবশ্য এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, জুনিয়রদের কাছ থেকে সিনিয়ররা যদি লজ্জা পেতে না চান তাহলে এখনই সংশোধন হোন। তা না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইজি তো সংশোধনের কথা বললেন, আমরাও পুলিশের সংশোধন চাই। তা না হলে সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হবে কেমন করে? কিন্তু সংশোধনের জন্য তো প্রয়োজন নৈতিকবোধ। আর এই নৈতিকবোধের উৎস হলো স্রষ্টা প্রেরিত পবিত্র ধর্ম। এই ধর্ম দর্শনের চর্চা আমাদের সমাজে, প্রতিষ্ঠানে কতটা হচ্ছে? নৈতিকবোধের উৎস থেকে বিমুখ হয়ে শুধু সংশোধনের আহ্বান জানালে তা কি তেমন ফলপ্রসূ হবে? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কী বলে?

http://www.dailysangram.com/post/320069