২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ১০:২০

শিক্ষার্থীদের স্মার্ট আইডি কার্ডের ৫০৮ কোটি টাকার প্রকল্প

প্রাথমিক পর্যায়ে অধ্যয়নরত প্রায় সোয়া দুই কোটি শিক্ষার্থীর একক আইডি দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ১৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এই প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একক ডিজিটাল আইডি কার্ড দেয়া হবে। এই কার্ডে শিক্ষার্থীর ছবি, পারিবারিক তথ্য, ঠিকানাসহ আনুষঙ্গিক আরো অনেক তথ্য সংযোজন করা হবে। এই কার্ড দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে।

এই একক পরিচিতি নম্বর দিয়ে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত অন্যান্য সেবা যেমন বই সরবরাহ, ভর্তি, উপবৃত্তি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তবে প্রকল্পের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে আপত্তি তুলেছেন পরিকল্পনা কমিশন। এ ছাড়াও ৩২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ধরনের আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের একই ধরনের কার্ড দেয়া হবে। ওই কার্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ট্র্যাকিং করা যাবে বলে জানা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ধরা হয়েছে সমন্বিত শিক্ষা তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা। আর ব্যানবেইস হবে সব সংস্থার ও বোর্ডের তথ্য আদান-প্রদানের একক উৎস। এই দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সরকারের খরচ হবে ৫০৮ কোটি টাকা। তবে দুটি প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিকল্পনা কমিশন। বেশ কয়েকটি সংশোধনী দিয়ে কমিশন এসব শর্ত মেনে প্রকল্প সংশোধনী করে আনতে বলেছে। সদুত্তর পেলেই প্রকল্প দুটি একনেকের অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। পরিকল্পনা কমিশন এবং শিক্ষা ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ‘প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল প্রণয়ন শীর্ষক প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। প্রকল্পের উদ্দেশ্য তুলে ধরে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) বলেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটার স্ট্যাটিটিকস (সিআরভিএস) একটি একক আইডি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সব নাগরিকদের জীবন প্রবাহের উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ তথ্য উপাত্ত আকারে সংরক্ষণ এবং এর ভিত্তিতে সরকারের সব সেবা নিশ্চিত করার একটি উদ্যোগ। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল ডাটাবেজ তৈরি করা যাতে একজন শিক্ষার্থীর সব তথ্য লিপিবদ্ধ থাকবে। প্রকল্পের ডিপিপিতে বলা হয়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণির দুই কোটি ১৭ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য প্রোফাইল প্রস্তুত করা। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একক পরিচিতি (আইডি) নম্বর দেয়া হবে। এই একক পরিচিতি নম্বরের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত অন্যনা্য সেবা যেমন (বই সরবরাহ, ভর্তি, উপবৃত্তি ইত্যাদি দেয়া)। কোনো শিক্ষার্থী যেখানে ঝরে যাবে তার তথ্য সেখানে থাকবে। প্রকল্পের পটভূমি তুলে ধরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে নির্বাচন কমিশন ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে ১০ কোটি নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, স্থানীয় সরকার ১২ কোটি নাগরিকের আরেকটি ডাটাবেজ, স্থাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১০ কোটি নাগরিকের জন্য সময়ভিত্তিক স্থাস্থ্য শুমারি করেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোতে ১৬ কোটি নাগরিকের জন্য একটি দারিদ্র্য ভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। এ সমস্ত ডাটাবেজ পারস্পারিক সমন্বয়যোগ্য বা ক্রিয়াশীল না হওয়ার বিদ্যমান ডাটাবেজ হতে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কোনো ডাটা তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না। এ ধরনের উপলব্ধি থেকেই সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার ভিত্তিতে একক সিআরভিসি তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

সেই আলোকে এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত। পুরো প্রকল্পের ব্যয় বহন করবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য ব্যয় দেখানো হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন ১ কোটি ৭৩ লাখ, উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ১৬ কোটি ১৭ লাখ, তথ্য সংগ্রহ ও ফর্ম মুদ্রণ ৪ কোটি ৩৪ লাখ, শিক্ষার্থীদের ছবিসহ তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই ২১ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ছবিসহ অনলাইনে ডাটা এন্ট্রি ৩৬ কোটি ৮০ লাখ, লেমিনেটিং আইডি কার্ড প্রিন্টিং ১ কোটি ৩০ লাখ, সরবরাহ ও সেবায় ৪ কোটি ৭০ লাখ, এনআইডি ভেরিফিকেশন ৮ কোটি টাকা, সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট ও ডাটা ক্লিনিং ২ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের তত্ত্ববাধানে একটি টিম কাজ করবে।

তবে প্রকল্পটি বেশ কিছু অংশে আপত্তি তুলেছেন পরিকল্পনা কমিশন। শিক্ষা উইং থেকে তোলা এ আপত্তিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিভিন্ন অংশের ব্যয়ের মধ্যে আন্তঃসমন্বয় পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে অন্যতম শিক্ষার্থীদের ছবিসহ তথ্য যাচাই বাছাই। এখানে ফরম ছাপানো এবং তার মাধ্যমে ছবিসহ তথ্য সংগ্রহ করা অনলাইনে এন্ট্রি করা হবে। ওয়েববেইজ সফটওয়ার ও ক্লাউড কম্পিউটিং যুগে এ ধরনের পদ্ধতি বর্তমানে কোনো প্রচলন নাই। এ ক্ষেত্রে সফটওয়ারের ফরম আপলোড করা যেতে পারে এবং ডাটা এন্ট্রির পর তা প্রিন্ট করে হার্ড কপি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। লেমিনেটিং আইডি কার্ড প্রিন্টিং বিষয়ে কেনা পদ্ধতিতে টেন্ডার করা হবে অন্যদিকে প্রিন্টার কেনার জন্য ৩ কোটি টাকা প্রিন্টার কেনার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা আসামঞ্জস্য দেখা গেছে। এ ছাড়াও বেশ কিছু মেশিনারিজ ও ইক্যুইপম্যান্টের কেনার প্রস্তাবে আসামঞ্জস্যতা পাওয়া যায়। প্রকল্পটি ওপর মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প যাচাই কমিটি সভার কার্যবিরণী ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়নি। ভৌত কাজ সর্ম্পকে কোনো অংশ না থাকার পরও ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগকে এ প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা বাবদ পৃথক অংশে ব্যয় ধরা হলেও সরবরাহ ও সেবা খাতে প্রশিক্ষণ সেমিনার ও বিনোদনের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। এটা আসামঞ্জস্য দেখা গেছে। এ ছাড়া এনআইডি যাচাইয়ের জন্য যে ৮ কোটি ব্যয় ধরা হয়েছে তা নির্বাচন কমিশনের দলিলাদি ডিপিপিতে জমা দেয়া হয়নি। এ ছাড়াও প্রকল্প শেষ হয়ে প্রতি বছর নতুন করে যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন তাদের আইডি দেয়া এবং আইডি ছাপানোর কাজ কীভাবে হবে, কারো কার্ড হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হলে কীভাবে প্রতিস্থাপন করা হবে তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ বিষয়টি স্পষ্ট নয়। প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) দিয়ে যাচাই করা হয়েছে বলা হলেও ডিপিপিতে এ সম্ভাব্যতার প্রতিবেদন দেয়া হয়নি। আর প্রাথমিক স্তরের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক পরিচিতি কার্ড খরচ ধরেছেন ৮৩ টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আইডি কার্ডের সঙ্গে খরচ তুলনা করে কমিশন বলেছে, মাধ্যমিক স্তরের কার্ডপ্রতি ৫৭ টাকা, আর প্রাথমিকে ২৬ টাকা বেশি করে ৮৩ টাকা দেখানো হয়েছে। এর জবাব এখনো দেয়নি প্রাথমিক মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পে এক কোটি টাকা রাখা হয়েছে বিদেশ ভ্রমণে। কমিশন থেকে জানতে চাওয়া হয়, কার্ড তৈরি করতে কেন বিদেশ ভ্রমণ করতে হবে। কমিশন আরো জানতে চায় যেহেতু ২০২০ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তাহলে পরের বছর থেকে যারা প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি হবে তাদের কী করা হবে? শিশুরা কার্ড হারিয়ে ফেলবে। নতুন কার্ডের টাকা কোত্থেকে আসবে?

এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তিগুলো ডিপিপিতে সংশোধন করা হচ্ছে। এমন কোনো প্রকল্প নেই যাতে অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশ ভ্রমণের খরচ ধরা হয় না। ফিনল্যান্ডে এ ধরনের একটি প্রকল্প রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতেই প্রকল্পে বিদেশে সফরের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন মনে করলে তা বাদ দেয়া হবে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=105859