১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:৫২

মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ভোগান্তি বাড়ছে

হারুন-আর-রশিদ

আমরা যাদের দেশ গড়ার কারিগর বলিÑ তারা আজ নিতান্ত অসহায়, তাদের নামনিশানা মুছে ফেলতে চাইছে ক্ষমতাধরেরা। ৪৭ বছর তারা শুধু দিয়ে গেছে, বিনিময়ে কিছুই পায়নি। এই শ্রেণীটি না পারে ওপরে উঠতে না পারে নিচে নামতে। মানসম্মান বোধটাই এই শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য। এরাই সরকার গঠন করে আবার এরাই শোষিত হয়। মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। গত ৪৭ বছরে উন্নয়ন হয়েছে দেশের ২০ থেকে ২৫ লাখ ক্ষমতাধর মানুষের। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার থেকে ৪৭ বছর ধরে কোনো সরকারের জন্ম হয়নি। পারিবারিক উত্তরাধিকারী সূত্র ধরে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বড় দু’টি দল। ৪৭ বছরের মধ্যে প্রায় ৩৮ বছর এই দুটি পরিবার ক্ষমতায় আসে পালাক্রমে। মাঝখানে সাড়ে ৯ বছর চলেছিল স্বৈরশাসন। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি চারটি বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। এখন দেশে চলছে বিতর্কিত গণতন্ত্র। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছিল, তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল দেশ বিদেশের পর্যবেক্ষক মহলের কাছে।

১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১৬ কোটি ৭৫ লাখ মানুষকে শোষণ করেছে ২৫ লাখ মানুষ। দেশের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ক্ষমতাহীন, তারা শোষিত, বঞ্চিত সব সুযোগ-সুবিধা থেকে। বিগত ৪৭ বছরে দেশের বৈদেশিক সাহায্য এসেছে কয়েক লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ওই ২৫ লাখ দুর্বৃত্ত লুণ্ঠন করেছে ৭৫ শতাংশ। দুষ্টচক্রের কারণে বছরে সৃষ্টি হচ্ছে কয়েক লাখ কোটি কালো টাকা, যা জাতীয় আয়ের তিন ভাগের এক ভাগ। এর সাথে আরো যুক্ত হয়েছে এক লাখ টাকার ওপরে ব্যাংক খেলাপি ঋণ। এরাই বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। পুঁজিবাজার থেকে বিগত ৪৭ বছরে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর অর্থ লুণ্ঠন করে পথে বসিয়েছে নব্যবণিকেরা। দেশে বিদেশে রয়েছে এদের একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি। এদের সন্তানেরা পড়াশোনা করে বিদেশে। এদের রয়েছে একাধিক গাড়ি, যার কারণে ঢাকার যানজটের স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। যত দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে মনে করে বাংলাদেশের মালিক শুধু তারাই। অন্যরা নি¤œশ্রেণীর প্রজা।
স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবিকল ছায়া দেখছি বিগত ৪৭ বছর ধরে। এক দল বা এক মতের আদর্শের রাজনীতির জন্য তো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। বহু দল বহু মতের আদর্শ প্রচারের জন্যই বাংলাদেশ স্বাধীন করা হয়েছিল। ঘরে বাইরে সব জায়গায় থাকবে সরকারি দলের পদচারণা। বিরোধী দল থাকবে শুধু অন্দর মহলে বা হোটেলে অথবা পার্টি অফিসে। এর নাম কী করে গণতন্ত্র হয় সেটা বুঝে আসে না। এখন অনেক কিছুই মেলাতে পারি না নিজের সাথে। বাসে উঠতে কষ্ট, রাস্তা পারাপারে কষ্ট, ফুটপাথে হাঁটতেও কষ্ট। কষ্ট নেই এমন কোনো জায়গা বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না।

ঢাকা শহরটাকে আমরা বস্তি বানিয়ে ফেলেছি গাড়ি কিনে আর বাড়ি বানিয়ে। সব কিছুই আবার অপরিকল্পিত। প্রকৃতি এখন মানুষের শত্রæ, সে জন্য নির্বিচারে গাছ কাটছে, দখল করছে নদী খাল বিল হাওর বাঁওড় সব কিছু। খালি রাখা যাবে না কোনো কিছু। পাহাড় পর্বত দখল করে কেটে ইটভাটা নির্মাণ করা হচ্ছে। মহাসড়কের গাছ সাবাড়, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের সড়কপথে গাছপালা কমে গেছে। প্রায় সময় বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে নদী দখলের সচিত্র প্রতিবেদন দেখানো হয়। এসব ব্যাপারে প্রশাসন নীরব, কারণ শাসক দলের লোকজনই এসব করছে। ঢাকার মতিঝিল, দিলকুশা, পুরানা পল্টন এক কথায় শহরের ফুটপাথ এখন কৃষিজাত পণ্যের বাজার ও গাড়ি পার্কিংয়ের রমরমা বাণিজ্য। সড়কপথের ৩০ থেকে ৪০ ফুট রাস্তা খেয়ে ফেলেছে নব্যবণিকদের গাড়ি। রাস্তা ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে। কারণ, মূল সড়কেও ব্যবসায়ের পসরা নিয়ে বসেছে হকারেরা। সড়কপথে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির বাণিজ্য চলছে।
নৈতিক মূল্যবোধ দেশে আছে বলে মনে হয় না। অথচ নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অলঙ্কার। শ্রেষ্ঠ নীতির সঠিক মূল্য সম্পর্কে অটল থাকাই হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ। নৈতিক মূল্যবোধই মানুষ ও পশুর মাঝে পার্থক্যের নির্দেশক।

নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ যা খুশি তা করতে পারে না। কিন্তু আজ এই মানুষ মূল্যবোধ হারিয়ে পশুসুলভ কাজগুলো দেদার করছে। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। মানুষের লোভ এত বেশি হয়ে গেছে যে, ক্ষমতায় একবার এলে আর যেতে চায় না। এ কারণে ক্ষমতায় থেকে নানারকম নীতিমালা তৈরি করে। প্রশাসনের প্রতিটি জায়গায় নিজের পছন্দনীয় লোক বসানো হয়। বিচার বিভাগও এর বাইরে নয়। ক্ষমতার লোভে বাইরে থাকা বড় বিরোধী দলকে রাস্তায় মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হয় না। বলা হয় এসব করলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু সরকারি দল প্রতিদিন দলীয় প্রোগ্রাম-নির্বাচনী প্রোগ্রাম নিয়ে গোটা বাংলাদেশ চষে বেড়ালেও জনজীবনে ব্যাঘাত ঘটে না। আসলে ক্ষমতার লোভ এমন স্তরে পৌঁছে গেলেই মানুষ নীতিহীন কর্মকাণ্ডগুলো করে। লাঠিয়াল বাহিনী, দলীয় বাহিনী, পুলিশ প্রশাসন সব কিছুই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। বলা হয় সংবিধানের বাইরে একচুল পরিমাণে যাওয়া যাবে না। অথচ ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের আগে সরকারি দল বিরোধী দলকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেয়ার কথা বলেছিলÑ সবাই মিলে সরকার গঠনের কথাও বলা হয়েছিল। তখন এই সংবিধানই ছিল। তখন যদি এসব কথা বলা যায়, তাহলে ২০১৮ সালে নির্বাচনে এসব কথা বলা যাবে না কেন? ক্ষমতার লোভ যখন অতিমাত্রায় ভর করে তখন আবোলতাবল কথাবার্তা আমরা আমজনতা রাষ্ট্রের মুখ থেকে অহরই শুনতে পাই। এবার আসুন বাড়ি গাড়ি একটি হলে চলবে না। একাধিক থাকতে হবে। এ হলো আরেক ধরনের লোভ, যার কোনো শেষ নেই। অর্থনীতির ভাষায় বলা যায় wants are unlimited অর্থাৎ চাহিদার শেষ নেই। কিন্তু ধর্মে বলা হয়েছেÑ তোমার যা আছে তা নিয়ে তুমি সন্তুষ্ট থাকো, তাহলে মনে শান্তি পাবে। টাকা পয়সা ধন সম্পত্তি বেশি হলে মনের শান্তি উধাও হয়ে যায়।

তখন মানুষের মধ্য থেকে মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। আমরা আজ এ ধরনের একটি সময়ের মধ্যে পথ চলছি। মানুষ অমানুষের পর্যায়ে ধাবিত হচ্ছে। ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয়, ইরাক ও লিবিয়ার লৌহ মানবদের দিকে তাকালে তা অনুধাবন করা সহজ হবে। বাংলাদেশে ৪৭ বছরের সরকারগুলোর পতনের দিকে তাকালেও এর সত্যতা বোঝা সহজ হবে। ক্ষমতা কার কিভাবে চলে যাবে বিশ্ব ইতিহাসের ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপ্রধানগুলোর দৃষ্টান্ত থেকে আমরা তা শিক্ষা নিতে পারি।
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
harunrashidar@gmamil.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/294569